সংবাদ বিজ্ঞপ্তি
ঢাকা, ৯ ডিসেম্বর ২০২৫: জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে দুর্নীতিবিরোধী বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে প্রতিবছরের ন্যায় এবারও আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস উদযাপন করছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুর্জয় তারুণ্য, একসাথে, এখনই’ এই প্রতিপাদ্যে দিবসটি উদযাপনে জাতীয় পর্যায়ে ‘কর্তৃত্ববাদের পতন-পরবর্তী বাংলাদেশের গণমাধ্যম পরিস্থিতি’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান এবং দুর্নীতিবিরোধী অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার ২০২৫ ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আয়োজিত মানববন্ধনে ঢাকাসহ সারাদেশের ৪৫টি অঞ্চলের সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক), অ্যাকটিভ সিটিজেনস গ্রুপ (এসিজি), ইয়ুথ এনগেজমেন্ট অ্যান্ড সাপোর্ট (ইয়েস) গ্রুপের সদস্যবৃন্দ অংশগ্রহণ করে। পাশাপাশি, দেশব্যাপী সনাক, এসিজি, ইয়েস গ্রুপে র আয়োজনে র্যালি, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এছাড়া, ফেসবুকে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে একসাথে, এখনই’ বার্তাসম্বলিত ফ্রেমসহ প্রোফাইল ছবি পরিবর্তনের বিশেষ ক্যাম্পেইন পরিচালনা করছে টিআইবি।
জাতীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ সকাল এগারটায় টিআইবির ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে ‘কর্তৃত্ববাদের পতন-পরবর্তী বাংলাদেশের গণমাধ্যম পরিস্থিতি’ শীর্ষক একটি আলোচনা অনুষ্ঠান আয়োজন এবং দুর্নীতিবিরোধী অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার ২০২৫ ঘোষণা করা হয়। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের ডেপুটি কোঅর্ডিনেটর জাফর সাদিক। প্রবন্ধে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ঐতিহাসিক ধারা ও বিভিন্ন আইনি কাঠামো, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ও সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ, নিবন্ধন ও মালিকানার ধরণ ইত্যাদি বিশ্লেষণের পাশাপাশি কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের পর গণমাধ্যমের বর্তমান পরিবেশ নিয়ে বিষদ আলোচনা করা হয়।
প্রবন্ধের উপস্থাপনের ওপর আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা ট্রিবিউনের সম্পাদক রিয়াজ আহমেদ, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও নিউজ টোয়েন্টি ফোর-এর সাবেক প্রধান বার্তা সম্পাদক শাহনাজ মুন্নী, চ্যানেল টোয়েন্টি ফোরের সাবেক নির্বাহী পরিচালক তালাত মামুন, যশোরের দৈনিক গ্রামের কাগজের সম্পাদক মবিনুল ইসলাম মবিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. শামীম রেজা, যমুনা টেলিভিশনের বার্তা প্রধান মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম, এএফপির বাংলাদেশ ব্যুরো প্রধান শেখ সাবিহা আলম এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকবৃন্দ। টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ঢাকা ট্রিবিউনের সম্পাদক রিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘সাংবাদিকতায় এমন স্বীকৃতি প্রয়োজন। তাই, এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যেন সাংবাদিকতার মান নিশ্চিত হয় এবং পাশাপাশি সাংবাদিকরা অনুপ্রেরণা পায়। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে গণমাধ্যমের পরিবেশ দূষিত করা হয়েছে, যার চর্চা এখনো বিদ্যমান। গণমাধ্যমকে এমনভাবে দূষিত করা হয়েছে যে, কেউ বলতে পারবেনা- গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নেই। কারন এমন বাস্তুতন্ত্র তৈরি করা হয়েছে যেখানে যে কেউ লাইসেন্স নিতে পারবে, কিন্তু এই লাইসেন্স কি বিবেচনায় দেওয়া হচ্ছে? এসবের ফলে গণমাধ্যমের প্রতি মানুষের বিশ্বাস কমে যাচ্ছে।’
এএফপি বাংলাদেশের ব্যুরো প্রধান শেখ সাবিহা আলম বলেন, ‘তথ্যই পারে অপ-তথ্যকে সরিয়ে দিতে। একইভাবে সাংবাদিকতাই অপসাংবাদিকতাকে সরিয়ে দেবে। এর প্রমাণ হলো বিগত বছরগুলোতে নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যেও গণমাধ্যমে ভালো ভালো প্রতিবেদন হয়েছে। তাই সাংবাদিকতাকে অব্যাহত রাখতে হবে। যত বেশি এটি করা হবে, গণমানুষের আস্থাও ততো বাড়বে।’
চ্যানেল ২৪ এর সাবেক নির্বাহী পরিচালক তালাত মামুন বলেন, ‘সাংবাদিকতা নানান চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। আস্থাহীনতা তার মধ্যে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে নিরাশ না হয়ে সংবাদ মাধ্যমের গুণগতমান নিশ্চিত করতে হবে। সাংবাদিকদের মধ্যে ঐক্যের অভাব আছে, যা পেশাগত ব্যর্থতা। কর্তৃত্ববাদ সরে যাবার পর অন্য শক্তি তৈরি হয়। তা সামলানোর জন্য সাংবাদিকরা নিজেদের তৈরি করছে কিনা- তা ভেবে দেখতে হবে।’
শাহানাজ মুন্নী বলেন, ‘গণমাধ্যম কমিশন ও এর সুপারিশ বাস্তবায়নের আলোচনা ইতিবাচক। এর মধ্যেই আমরা চাই আসন্ন নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো যেন গণমাধ্যম কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তাবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। অতীতে চ্যানেল কম থাকলেও, একটি ভালো সংবাদে সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হতো। কিন্তু এখন গণমাধ্যম বাড়লেও, সঙ্গে বেড়েছে কোলাহল। এছাড়া, গণমাধ্যমে নারীর উপস্থিতি তেমন নেই, অনেকেই আগ্রহী নন। নারী সাংবাদিকদের কাজের পরিবেশ উন্নত হয়নি।’
আলোচনায় টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “গণমাধ্যম দেশের সার্বিক রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর বাইরে না। জনকল্যাণে অপরিহার্য পণ্য - সংবাদ, তথ্য ও প্রতিবেদন, তথা পাবলিক গুড উৎপাদনকারী হিসেবে যেখানে সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক হিসেবে স্বীকৃত হওয়ার কথা, সেখানে দেশের সকল সরকার ধারাবাহিকভাবে গণমাধ্যমকে তাদের অন্যতম শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে আসছে। যে কারণে মুক্ত গণমাধ্যম উপযোগী সংস্কার দূরে থাক, অন্তবর্তী সরকারের আমলে এক্ষেত্রে সংস্কারের নামে যা হয়েছে, বিশেষ করে সাইবার সুরক্ষা, ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা ও জাতীয় উপাত্ত ব্যবস্থাপনা, ইত্যাদি নামে যে অধ্যাদেশগুলো প্রণীত হয়েছে, তার ফলে সরকারের কর্তৃত্বে নজরদারি কাঠামো অধিকতর নিবর্তনমূলক হয়েছে। যা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সার্বিকভাবে বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য গভীরতর উদ্বেগজনক হয়েছে। তাই গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নে যে অগ্রগতি নেই, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদের বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ দোসর ছিল গণমাধ্যম, অনেক ক্ষেত্রে গণমাধ্যম আত্নসমর্পণ করেছে। অনেকে সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে গণমাধ্যমের ঘরের শত্রুর ভূমিকায় লিপ্ত হয়েছে। এতে করে গণমাধ্যমের যারা পেশাগত দেউলিয়াপনার শিকার হয়েছে তাদের জন্য পুরো খাতের ওপর জনআস্থাও ঝুঁকিতে পড়ছে। এজন্য আয়নার মুখোমুখি হয়ে আত্মজিজ্ঞাসা গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে ৫ আগস্ট ২০২৪ থেকেই সারাদেশে যে দলবাজি, দখলবাজি, ট্যাগিং, মামলা বাণিজ্য, গ্রেফতার বাণিজ্য, তালিকা বাণিজ্য হয়েছে এবং এতে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক শক্তি যেমন জড়িত ছিল তেমনিভাবে গণমাধ্যমের একাংশও ভূমিকা রেখেছে। যা জাতীয় পর্যায়ের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে চলমান রয়েছে। বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদের বিকাশ হয়েছে দীর্ঘ প্রক্রিয়ায়। চর্চা হয়েছে জিরো সাম গেইমের। ধারাবাহিক এ প্রক্রিয়া গত ১৫ বছরে চূড়ান্ত বিকশিত হয়ে চোরতন্ত্র বা ক্লেপ্টোক্রেসিতে পরিণত হয়েছে। পট পরিবর্তনের পর গণমাধ্যমসহ যারা নিজেদের বিজয়ী ভাবছেন, তাদের একাংশ ‘এখন আমাদের পালা’ - এই হীনমন্যতায় নিমজ্জিত হয়ে একই চর্চা বজায় রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। সংস্কারের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল সেটিকে তাঁরাই ধূলিসাৎ-এর ঝুঁকিতে ঠেলে দিয়েছেন।”
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “গণমাধ্যমে সংস্কারের জন্য অনেককিছুই বাস্তবায়িত হয়নি এখনও। প্রতিটি সংস্কার কমিশনের আশু বাস্তবায়নযোগ্য অনেক সুপারিশ ছিল। সরকার নিজেরাই বলেছিলেন আশু বাস্তবায়নযোগ্য প্রস্তাবনার তালিকা তৈরি করে দিতে। কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়ন হয়নি। কোথায় প্রতিবন্ধকতা ছিল? সকলেই মুখে সংস্কার চায়। কিন্তু যারা সংস্কারের মূল চালিকাশক্তি হওয়ার কথা, তাদের ভেতরেই যে প্রতিরোধমূলক শক্তি নিয়ামকের ভূমিকায় রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম আমলাতন্ত্র। সংস্কার হতে হলে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পাশাপাশি আমলাতন্ত্রেরও পরিবর্তন হতে হবে। সেটি নাহলে জনগণকে আবারো ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে নামতে হবে।”
আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে টিআইবির দুর্নীতিবিরোধী অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার ২০২৫ ঘোষণা করা হয়। এ বছর বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ৪ জন সাংবাদিক ও একটি প্রামাণ্য অনুষ্ঠানকে এই পুরস্কার দেয়া হয়। আঞ্চলিক সংবাদপত্র বিভাগে বিজয়ী হয়েছেন যশোরের দৈনিক গ্রামের কাগজের জ্যেষ্ঠ নিজস্ব প্রতিবেদক ফয়সাল ইসলাম এবং নিজস্ব প্রতিবেদক আশিকুর রহমান শিমুল। জাতীয় সংবাদপত্র বিভাগে বিজয়ী হয়েছেন ইংরেজি পত্রিকা দ্যা ডেইলি সান-এর জেষ্ঠ্য নিজস্ব প্রতিবেদক রাশেদুল হাসান। টেলিভিশন (প্রতিবেদন) বিভাগে বিজয়ী হয়েছেন একাত্তর টেলিভিশনের সাবেক বিশেষ প্রতিবেদক (বর্তমানে চ্যানেল ওয়ানের ইনপুট প্রধান এবং পরিকল্পনা সম্পাদক) মুফতি পারভেজ নাদির রেজা। বিজয়ীদের প্রত্যেককে সম্মাননাপত্র, ক্রেস্ট ও এক লক্ষ পঁচিশ হাজার টাকা পুরস্কার প্রদান করা হয়। টেলিভিশন (প্রামাণ্য অনুষ্ঠান) বিভাগে বিজয়ী হয়েছে চ্যানেল টোয়েন্টি ফোরের প্রামাণ্য অনুষ্ঠান ‘সার্চলাইট’। এই প্রামাণ্য অনুষ্ঠানটি অনুসন্ধান ও উপস্থাপনা করেন সার্চলাইট টিমের সাবেক বিশেষ প্রতিবেদক (বর্তমানে স্টার নিউজ-এর বিশেষ প্রতিবেদক) মু. ফয়জুল আলম সিদ্দিক। বিজয়ী প্রামাণ্য অনুষ্ঠানটির জন্য সম্মাননাপত্র, ক্রেস্ট এবং এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকার পুরস্কার প্রদান করা হয়।
গণমাধ্যম যোগাযোগ:
মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম
পরিচালক, আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন
মোবাইল: ০১৭১৩-১০৭৮৬৮
ই-মেইল: tauhidul@ti-bangladesh.org