সংবাদ বিজ্ঞপ্তি
ঢাকা, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫: বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) কর্তৃক প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই) ২০২৪-এ বাংলাদেশের স্কোর ২০২৩ এর তুলনায় এক পয়েন্ট কমে ২৩ এবং উর্ধ্বক্রম অনুযায়ী অবস্থানের দুই ধাপ অবনতি হয়ে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৫১তম। বাংলাদেশের এবারের স্কোর ২০১২ সাল থেকে ১৩ বছরে সর্বনিম্ন; যা প্রমাণ করে যে, চৌরতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদী সরকার মুখে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বললেও, বাস্তবে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছে, লালন করেছে, এমনকি দুর্নীতি সংঘটনে সহায়তা ও অংশগ্রহণ করেছে। এর প্রভাবে যথেচ্ছ লুটপাট, দুর্নীতিবাজদের রাষ্ট্রীয়ভাবে তোষণ, আইনের সঠিক প্রয়োগ না করা এবং সার্বিক কাঠামোগত দুর্বলতায় বাংলাদেশের অবস্থানের ক্রমঅবনতি হয়েছে। ভঙ্গুর এই কাঠামো ঠিক করে দুর্নীতির রাশ টানা এবং দুর্নীতিবাজদের কঠোর বিচারের জন্য টিআইবি ছয় দফা সুপারিশ প্রদান করেছে ।
আজ দুপুরে সিপিআই ২০২৪-এর বৈশ্বিক প্রকাশের অংশ হিসেবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরে নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান জানান, ‘সিপিআই অনুযায়ী, ২০১২ থেকে ব্যবহৃত ০-১০০ স্কেলে বাংলাদেশের স্কোর ২০২২ সাল পর্যন্ত ২৫ থেকে ২৮ এর মধ্যে আবর্তিত ছিলো। কিন্তু ২০২৩ সালে এক পয়েন্ট কমে এক যুগের মধ্যে সর্বনিম্ন ২৪ হওয়ার পর, এ বছর আরো এক কমে ১৩ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ সর্বনিম্ন ২৩ স্কোর পেয়েছে। সূচকে অন্তর্ভূক্ত ১৮০টি দেশের মধ্যে কম স্কোর পাওয়া দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৪তম।’ সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন সংস্থাটির উপদেষ্টা- নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০২৪ সালের সূচকে ৯০ স্কোর পেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে ডেনমার্ক; ৮৮ স্কোর নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে ফিনল্যান্ড ও ৮৪ স্কোর পেয়ে তৃতীয় স্থানে সিঙ্গাপুর। আর ৮ স্কোর পেয়ে তালিকার সর্বনিম্নে অবস্থান করছে দক্ষিণ সুদান; ৯ স্কোর পেয়ে নিম্নক্রম অনুযায়ী দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সোমালিয়া এবং ১০ স্কোর পেয়ে তৃতীয় সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে ভেনেজুয়েলা। সংবাদ সম্মেলনে আরো জানানো হয়, সিপিআই—এ অন্তর্ভূক্ত ১৮০টির মধ্যে ৫৭ শতাংশ (১০১টি) দেশ বৈশ্বিক গড় ৪৩ এর কম স্কোর পেয়েছে এবং ৬৮ শতাংশ (১২২টি) দেশের স্কোর ৫০ এর নিচে। এবছর সূচকে অন্তর্ভূক্ত এক-চতুর্থাংশ (৪৭টি) দেশ ২০১২ সাল থেকে গত ১৩ বছরের মধ্যে তাদের সর্বনিম্ন স্কোর পেয়েছে।
এবছর সিপিআই-এর প্রতিপাদ্য “দুর্নীতি ও জলবায়ু সংকট” জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে ড. জামান বলেন, ‘সূচকের এবারের বিশ্লেষণ মতে বাংলাদেশ এমন সব দেশের পর্যায়ে রয়েছে, যারা দুর্নীতির ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। বাংলাদেশে দুর্নীতির মাত্রা অতি উদ্বেগজনক। দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তানের পরই বাংলাদেশ দ্বিতীয় সর্বনিম্ন স্কোর ও অবস্থানে রয়েছে। সিপিআই অনুযায়ী দেখা যায় যে, ২৪টি পূর্ণ গণতান্ত্রিক, ৫০টি ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক, ৩৬টি হাইব্রিড গণতান্ত্রিক ও ৫৯টি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের গড় স্কোর যথাক্রমে ৭৩, ৪৭, ৩৭ ও ২৯; অন্যদিকে বাংলাদেশের স্কোর ২৩, যা বৈশ্বিক গড়ের চেয়েও ২০ পয়েন্ট কম।’
স্কোর বিবেচনায় গতবারের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্লেষণে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরো বলেন, ‘নাগরিক স্বাধীনতা ও মানবউন্নয়ন সূচকে সর্বনিম্ন অবস্থানে থাকা দেশের চেয়েও আমাদের স্কোর কম। এমনকি সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত অঞ্চল, সাব-সাহারান আফ্রিকার দেশগুলোর চেয়েও বাংলাদেশে অর্জিত স্কোর ১০ পয়েন্ট কম। ২০১২ সালের পর এ বছরের স্কোর সর্বনিম্ন, যা উদ্বেগজনক ও হতাশাব্যঞ্জক। আরও লক্ষণীয়, আমাদের দেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ এমন সব দেশে যাচ্ছে, যারা সূচক অনুযায়ী ভালো অবস্থানে আছে। দেশে ঘটে যাওয়া দুর্নীতির দায় আমাদের, অর্থপাচার রোধে ব্যর্থতার দায়ও আমাদের। কিন্তু সার্বিকভাবে সকল দায় শুধুই বাংলাদেশের— বাস্তব চিত্র এমন নয়। সূচকে ওপরের দিকে থাকা দেশগুলোতে দৈনন্দিন জীবনে দুর্নীতির সুযোগ কম হতে পারে, কিন্তু তাদের আইন প্রয়োগ ও চর্চার ক্ষেত্রে এত ফাঁকফোকর রয়েছে যে সেখানে যথেচ্ছভাবে পাচারকৃত অর্থ লগ্নি করা সম্ভব। ফলে বাস্তবক্ষেত্রে অর্থপাচারের ফলে লাভবান হিসেবে ঐসব দেশ আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতি বিকাশে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করছে।’
উপস্থাপিত সূচকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনকাল পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণের সুযোগ নেই উল্লেখ করে ড. জামান বলেন, ‘কর্তৃত্ববাদের পতন হলেও, উক্ত সময়সীমা পর্যন্ত (সেপ্টেম্বর ২০২৪) দলবাজি, দখলদারি, চাঁদাবাজি ভিন্ন নামে ভিন্ন পরিচয়ে অব্যাহত ছিলো। তাই বলা যায়, সামান্য হলেও কর্তৃত্ববাদ পতন পরবর্তী সময়ের পরিস্থিতির প্রতিফলন এখানে রয়েছে। দুর্নীতি প্রতিহত করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাসমূহের মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেষ্টা করছে অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার। কিন্তু তা অব্যাহত থাকবে কিনা তা নির্ভর করছে মূলত সংস্থাটির সক্ষমতার ওপর। দুদকের প্রতি জনগণের যে প্রত্যাশা আছে, সেই লক্ষ্য অনুযায়ী কাজ করার পাশাপাশি দুদক সংস্কার কমিশনের সুপারিশসমূহ বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের স্কোর পরবর্তীতে বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার সহযোগিতা জরুরি।’
বিগত কর্তৃত্ববাদী সরকারের আমলে দুর্নীতিকে সামাজিকীকরণের অপচেষ্টার চর্চার পরিবর্তন আনার আহ্বান জানিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরো বলেন, ‘বাজেটে কালো টাকা সাদা করার বিধানের মাধ্যমে পতিত সরকার দুর্নীতি করতে উৎসাহ দিয়েছিল। দুর্নীতিকে সরকারিভাবে যেমন সুরক্ষা ও বিচারহীনতা দেওয়া হয়েছিলো, তেমনি সামাজিকভাবেও একে স্বাভাবিকতায় পরিণত করা হয়েছিলো। এই সংস্কৃতিকে সর্বস্তরে পরিহার করতে হবে। আশঙ্কার বিষয় হল কর্তৃত্ববাদের পতন হলেও অনেকক্ষেত্রেই কর্তৃত্ববাদী চর্চার পরিবর্তন হয় নি। তবে আমরা আশাবাদী আমাদের তরুণ প্রজন্ম দুর্নীতির সংস্কৃতি নির্মূলের যে সুযোগ করে দিয়েছে, তা অবলম্বন করেই এ অবস্থা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটবে।’
২০২৪ সালের সিপিআই অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র ভুটানের স্কোর ২০২৩ এর তুলনায় ৪ পয়েন্ট উন্নতি হয়েছে। অবশিষ্ট ৭টি দেশের স্কোরই ১ থেকে ৩ পয়েন্ট অবনমন হয়েছে। এর মধ্যে আফগানিস্তানের সর্বোচ্চ ৩ পয়েন্ট, পাকিস্তান ও শ্রীলংকার ২ পয়েন্ট এবং বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও মালদ্বীপের স্কোর ১ পয়েন্ট করে অবনতি হয়েছে। ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী এ বছর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র ভুটান ও নেপালের অবস্থানের যথাক্রমে ৮ ধাপ ১ ধাপ উন্নতি হয়েছে এবং অবশিষ্ট ৬টি দেশের অবস্থানের ২ থেকে ৬ ধাপ পর্যন্ত অবনতি হয়েছে। এর মধ্যে শ্রীলংকার ৬ ধাপ, আফগানিস্তান, ভারত ও মালদ্বীপের ৩ ধাপ এবং বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের অবস্থানের ২ ধাপ অবনমন হয়েছে। উল্লেখ্য, দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র ভুটান ছাড়া বাকি সাতটি দেশই সূচকের গড় স্কোর ৪৩—এর কম পয়েন্ট পেয়েছে। অর্থাৎ সার্বিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতা বেশ উদ্বেগজনক।
সিপিআই—এ দুর্নীতির ধারণার মাত্রাকে ০-১০০ এর স্কেলে নির্ধারণ করা হয়। “০” স্কোরকে দুর্নীতির কারণে সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ত এবং “১০০” স্কোরকে দুর্নীতির কারণে সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত বা সর্বাধিক সুশাসিত বলে ধারণা করা হয়। সূচকে অন্তর্ভুক্ত কোনো দেশই এখন পর্যন্ত শতভাগ স্কোর পায়নি। অর্থাৎ, দুর্নীতির ব্যাপকতা সর্বনিম্ন— এমন দেশগুলোতে কম মাত্রায় হলেও দুর্নীতি বিরাজ করে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সিপিআই নির্ণয়ে টিআইবি কোনো ভূমিকা পালন করে না। এমনকি টিআইবির গবেষণা থেকে প্রাপ্ত কোনো তথ্য বা বিশ্লেষণ সিপিআই—এ অন্তর্ভূক্ত করার সুযোগ নেই। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের টিআই চ্যাপ্টারের মতো টিআইবিও দুর্নীতির ধারণা সূচক দেশীয় পর্যায়ে প্রকাশ করে মাত্র। সিপিআই ২০২৪ এর তথ্যসূত্র হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জন্য সর্বমোট ১৩টি জরিপ ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে গতবারের মতো ৮টি জরিপই ব্যবহৃত হয়েছে। জরিপগুলো হলো: বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি পলিসি অ্যান্ড ইনস্টিটিউশনাল অ্যাসেসমেন্ট, ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম এক্সিকিউটিভ ওপিনিয়ন সার্ভে, গ্লোবাল ইনসাইট কান্ট্রি রিস্ক রেটিংস, বার্টেলসম্যান ফাউন্ডেশন ট্রান্সফরমেশন ইনডেক্স, ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট রুল অব ল ইনডেক্স, পলিটিক্যাল রিস্ক সার্ভিসেস ইন্টারন্যাশনাল কান্ট্রি রিস্ক গাইড, ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট কান্ট্রি রিস্ক রেটিংস এবং ভ্যারাইটিস অব ডেমোক্র্যাসি প্রজেক্ট ডেটাসেট—এর রিপোর্ট। উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের সিপিআই-এ ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
সিপিআই অনুযায়ী দুর্নীতির সংজ্ঞা হচ্ছে ব্যক্তিগত সুবিধা বা লাভের জন্য ‘সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার’ (abuse of public power for private gain)। সিপিআই নির্ণয়কালে জরিপের তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সর্বোচ্চ মান এবং বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। সূচক নির্ণয়ে অনুসৃত জরিপ ও গবেষণাপদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ভিজিট করুন: www.ti-bangladesh.org/cpi
গণমাধ্যম যোগাযোগ:
মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম
পরিচালক, আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন
মোবাইল: ০১৭১৩-১০৭৮৬৮
ই-মেইল: tauhidul@ti-bangladesh.org