নতুন বাংলাদেশ: দুর্নীতি প্রতিরোধ, গণতন্ত্র ও সুশাসন

রাষ্ট্রকাঠামো ঢেলে সাজাতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি টিআইবির নয়টি কৌশলগত ক্ষেত্রে সুপারিশ

সংবাদ বিজ্ঞপ্তি

ঢাকা, ২৮ আগস্ট ২০২৪: ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মূল বার্তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার নিশ্চিত করতে এবং দুর্নীতিমুক্ত, গণতান্ত্রিক ও সুশাসিত “নতুন বাংলাদেশ” বিনির্মাণে রাষ্ট্রকাঠামোকে ঢেলে সাজানোর আহ্বান জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। রাষ্ট্রকাঠামোতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের লক্ষ্যে নয়টি কৌশলগত বিষয়ের সন্নিবেশনে অন্তবর্তীকালীন সরকারের জন্য সুপারিশমালা প্রেরণ করেছে সংস্থাটি। সুপারিশমালায় বলা হয়, জনপ্রতিনিধিত্ব, সরকার ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও চর্চায় এমন আমূল পরিবর্তন আনতে হবে যেন জনগণের রায় ও অর্পিত ক্ষমতায় এবং জনগণের প্রতি কার্যকর জবাবদিহিতার মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। কতৃ©ত্ববাদী সরকার পতনের ফলশ্রুতিতে নতুন কর্তৃত্ববাদ ও দলীয় প্রভাবে পরিচালিত শাসনের উত্থানের ঝুঁকি প্রতিহত করতে দুর্নীতি প্রতিরোধ, গণতন্ত্র, সুশাসন ও শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রকাঠামোতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের লক্ষ্যে এ সুপারিশমালা প্রস্তুত করেছে টিআইবি।

গণতান্ত্রিক চর্চা, আইনের শাসন ও মানবাধিকার, অনিয়ম-দুর্নীতি প্রতিরোধ ও অর্থপাচার রোধ, সাংবিধানিক, সংবিধিবদ্ধ, সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, তথ্য অধিকার ও ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা, স্থানীয় সরকারব্যবস্থা, ব্যাংক খাত এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও পরিবেশ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কৌশলগত সুপারিশ করেছে টিআইবি। সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন- অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য দলনিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। জাতীয় সংসদে জনরায়ের বাস্তব প্রতিফলন নিশ্চিত করতে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান যে ম্যান্ডেট অন্তর্বর্তী সরকারকে দিয়েছে, সেই রাষ্ট্রকাঠামো পুনর্গঠনের লক্ষ্য অর্জন সাপেক্ষে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের মনোনয়নে কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ তরুণ প্রতিনিধি থাকতে হবে। পাশাপাশি, নির্বাচিত সংসদ সদস্যসহ জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে গণ-অনাস্থা প্রকাশের মাধ্যমে অপসারণ এবং উক্ত সংসদীয় আসনে/স্থানীয় সরকার এলাকায় পুনরায় নির্বাচনের বিধান নিশ্চিতের সুপারিশ করেছে টিআইবি।

এ ছাড়া, নিরপেক্ষ ও স্বার্থের দ্বন্দ্বমুক্তভাবে সংসদ ও নির্বাহী বিভাগের কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য একই ব্যক্তি একইসঙ্গে সরকারপ্রধান (প্রধানমন্ত্রী), দলীয় প্রধান ও সংসদ নেতা থাকতে পারবেন না এবং দুই মেয়াদের বেশি একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না- এমন বিধান সৃষ্টির পরামর্শ দিয়েছে টিআইবি। অন্যদিকে, আইনের শাসন ও মানবাধিকার নিশ্চিতে মাসদার হোসেন মামলার রায় অনুযায়ী বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ-প্রক্রিয়া অনতিবিলম্বে সম্পন্ন করতে সুপারিশ করে টিআইবি। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও মর্যাদা নিশ্চিত করা এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম স্বাধীনভাবে পরিচালনার জন্য বিচার বিভাগের পরিপূর্ণ ক্ষমতায়িত নিজস্ব সচিবালয় স্থাপন ও কার্যকর করা, উচ্চ এবং অধস্তন আদালতের নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলিসহ সার্বিক নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধান এককভাবে সুপ্রিম কোর্টের কর্তৃত্বাধীন সচিবালয়ের ওপর ন্যস্ত করতে পরামর্শ দিয়েছে টিআইবি।

নজিরবিহীন প্রাণহানি ও ত্যাগের বিনিময়ে দেশের দীর্ঘকালের কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক, দুর্নীতিমুক্ত, বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার উপযোগী রাষ্ট্রকাঠামো তৈরির পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার “ডকট্রিন অব নেসেসিটি”-এর ওপর নির্ভর করে, জনগণের প্রত্যাশার ওপর ভিত্তি করে গঠিত হয়েছে। আমরা আশা করি এই প্রত্যাশার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এই সরকারের পাশাপাশি নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে সকল অংশীজনই ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মূল চেতনা ও বার্তাকে ধারণ করে স্ব-স্ব ভূমিকা পালন করবেন। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন না হলে আমরা যতই রাষ্ট্রসংস্কারের কথা বলি না কেন, নতুন বাংলাদেশের কথা বলি না কেন, তা অর্জিত হবে না। ব্যক্তির পরিবর্তন বা শুধু প্রতিষ্ঠানের সংস্কার যথেষ্ট নয়। মানুষের ভোটাধিকারকে খর্ব করার যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল, তার পেছনে এ সময় রাজনীতির মাঠে যারা সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন, তাদের সকলেরই কম বেশি দায় আছে- তা ভুলে গেলে চলবে না। কাজেই তারা যদি এই সংস্কৃতির থেকে সরে না আসেন, আবার যদি যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় যেতে চান এবং “এটা আমাদের পালা” এমন মানসিকতায় ভর করে ক্ষমতার চর্চা ও তা আঁকড়ে ধরে থাকতে চান তাহলে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের স্বপ্ন অধরা থেকে যাবে।’

পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনা প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে আমরা দুদক, সিআইডি, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বিএফআইইউ- এ সকল সংস্থাসমূহকে একত্রে কাজ করার জন্য টাস্কফোর্স গঠনের প্রস্তাব করছি। কর্তৃত্ববাদী সরকারের আমলে এই প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেনি, কারণ যারা অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তারা ক্ষমতার অংশীদার ছিলেন। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণের মাধ্যমে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা এবং এর সঙ্গে যারা জড়িত তাদেরও চিহ্নিত করা ও বিচারের সম্মুখীন করা অবশ্যই সম্ভব। আমাদের আইনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা সম্ভব। যার রোডম্যাপ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের হাতে রয়েছে। যার মাধ্যমে ২০০৭ এ শুরু হওয়া প্রক্রিয়ায় ২০১৩ সালে ক্ষমতাধর ব্যক্তির সিঙ্গাপুরে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনা হয়েছিলো। এই প্রক্রিয়া বর্তমানে আরো বেশি মসৃণ ও সহজ হয়েছে।’

ছাত্র-জনতার আন্দোলনসহ বিভিন্ন সময়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাসমূহের সদস্যদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম ও অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘন, অনিয়ম-দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের তদন্তপূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে এবং সকল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী (পুলিশ, র‌্যাব, গোয়েন্দা সংস্থা) এবং প্রশাসনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করার জন্য ঢেলে সাজাতে সুপারিশ করেছে টিআইবি। তা ছাড়া, ছাত্র-জনতা যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় বিচার চায়, মব জাস্টিস চায় না। বিচারপ্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়, এমন সব কার্যক্রম অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। সকল সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ নিশ্চিত করতে এবং এ সব প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও সদস্যদের নিয়োগে দলীয়করণ চিরস্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হবে। একইসঙ্গে, বিদ্যমান দলীয় লেজুড়বৃত্তিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা, গণমাধ্যম, আইন পেশাসহ সকল পেশাজীবী, বিশেষায়িত ও সেবাখাতভিত্তিক সংগঠন/সমিতি বিলুপ্ত করে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষায় দলীয় প্রভাবমুক্ত সংগঠন/সমিতি প্রতিষ্ঠা করার সুপারিশ করে টিআইবি।

প্রস্তাবিত সুপারিশমালায় টিআইবি আশু প্রাধান্যের ক্ষেত্র হিসেবে উল্লেখ করেছে- শান্তি-শৃঙ্খলা, জননিরাপত্তা ও প্রশাসনিক স্বাভাবিকতা নিশ্চিত করা; নজিরবিহীন প্রাণহানিসহ বহুমাত্রিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য সরাসরি ও হুকুমের অপরাধে দায়ী সকলকে জাতিসংঘের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য জবাবদিহি নিশ্চিত করা; অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা; উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতি ও অর্থপাচারের কার্যকর জবাবদিহির অনুকরণীয় উদাহরণ স্থাপনে দুদক, বিএফআইইউ, এনবিআর, সিআইডি ও অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন করা; ‘‘নতুন বাংলাদেশ’’ এর অভীষ্ট ও লক্ষ্য অর্জনে রাষ্ট্র-সংস্কারের অপরিহার্য কাঠামো বিনির্মাণের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কৌশলগত পথরেখা প্রকাশ করা।

রাষ্ট্রকাঠামোতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের লক্ষ্যে নয়টি কৌশলগত বিষয়ের সন্নিবেশনে প্রস্তুতকৃত সুপারিশমালা ২৫ আগস্ট অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ সকল উপদেষ্টাগণকে প্রেরণ করেছে টিআইবি। এই সুপারিশমালা বিষয়ে আজ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলো শাহজাদা এম আকরাম ও মো. জুলকারনাইন। সংস্থাটির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনটি সঞ্চালনা করেন।

গণমাধ্যম যোগাযোগ:
মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম
পরিচালক, আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন
মোবাইল: ০১৭১৩-১০৭৮৬৮
ই-মেইল: tauhidul@ti-bangladesh.org

Read in English

TIB recommends the interim government to reform the state in nine strategic areas


Press Release