User Rating: 



/ 12
দুর্নীতি শব্দটি যেন আমাদের জীবনে এক প্রাত্যহিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোথায় নেই দুর্নীতি? প্রতিনিয়তই যেন এ আগ্রাসী দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ছে গ্রাম থেকে শহরে, সমাজ থেকে রাষ্ট্রে।এসব দুর্নীতির কিছু ঘটে খুব সাধারণ ভাবে আমাদের চোখের সামনেই আর কিছু ঘটে অত্যন্ত গোপনে। দুর্নীতি ঘটে ক্ষুদ্র পরিসরে ঘটে বৃহৎ পরিসরেও।দুর্নীতি যেভাবেই ঘটুক না কেন আর এর পরিধি যাই হোক না কেন এর প্রভাব পড়ে পুরো সমাজে, সকল নাগরিক কোন না কোন ভাবে হয় ক্ষতিগ্রস্ত।
লোকচক্ষুর অন্তরালে ঘটে যাওয়া সেইসব দুর্নীতির চিত্র কখনওবা উঠে আসে পত্রিকার পাতায় আবার কিছু থেকে যায় খবরের অন্তরালে।অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মাধ্যমে সেইসব তথ্যই তুলে আনেন সাংবাদিকগণ যেসব তথ্য জনসাধারণের নাগালের বাইরে থেকে যায়।গভীর অনুসন্ধানের মাধ্যমে সংগৃহীত সেইসব তথ্য দিয়ে তৈরী হয় অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। অনুসন্ধানী প্রতিবেদন হয় দুর্নীতি, রাজনীতি, সন্ত্রাস, মানবাধিকার বা এধরনের অন্য কোন ইস্যু নিয়ে যা সুশাসনের সাথে সম্পৃক্ত।
পৃথিবীর অনেক দেশেই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দুর্নীতি প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়েছে। আমাদের দেশেও আছে কিছু উদাহরণ। তবে তা খুব উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেনি। অত্যন্ত শক্তিশালী এই মাধ্যমটি দুর্নীতি প্রতিরোধে ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় হতে পারে অনন্য। এদেশের ভাষা আন্দোলন থেকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন সবখানেই গণমাধ্যমের অনস্বীকার্য ভূমিকা ছিল। আজ তাই সুশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে, দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে সরব হতে হবে গণমাধ্যমকে।
সরকার ব্যবস্থার চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত গণমাধ্যমকে তাই শক্তিশালী করার দায়িত্ব যেমন সরকারের তেমনি সংশ্লিষ্ট সকলের। গণমাধ্যমইতো সেই বন্ধু যে আমাদের কথাগুলো পৌঁছে দেয় সরকারের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে আর রাষ্ট্রের সকল কাজে আয়না হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সামনে যাতে আমরা তা জানতে পারি। তবে অবশ্যই গণমাধ্যমকে হতে হবে স্বচ্ছ, দলনিরপেক্ষ। গণমাধ্যমের দায়িত্ব তাদের ভূমিকা সততার সাথে যথাযথভাবে পালন করা। কোন দল, মহল বা ব্যক্তির চাপ বা পক্ষপাতিত্ব থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে হবে। সাংবাদিকরা দুর্নীতি প্রতিরোধে অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। তারা যদি সৎ হন, সাহসী হন, পক্ষপাতহীন হন তবে সকল দুর্নীতি উন্মোচিত হবে।
এটি সত্য যে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বিষয়ে আমাদের দেশের সংবাদকর্মীদের বিশেষত স্থানীয় পর্যায়ের সাংবাদিকদের রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা, রয়েছে দক্ষতার অভাব। রাজনৈতিক- সামাজিক প্রভাব, সন্ত্রাস, অর্থের অপর্যাপ্ততা যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে হাতে কলমে প্রশিক্ষণের অভাব। জাতীয় সংবাদপত্র বা টেলিভিন চ্যানেলগুলোর রাজধানী ভিত্তিক সাংবাদিকরা কিছুটা সুযোগ সুবিধা পেলেও নানা মহলের চাপে থাকেন তারাও। তাই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনও আমরা পাই স্বল্প পরিসরেই। অথচ দুর্নীতি প্রতিরোধে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা রাখতে পারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) দুর্নীতি প্রতিরোধে ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ১৯৯৬ সাল থেকে দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলন এ নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। এ আন্দোলনে টিআইবি গণমাধ্যকে সামিল করেছে এর শুরু থেকেই। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় পেশাদারী উৎকর্ষ সাধন ও দুর্নীতি বিষয়ে গণমাধ্যম কর্মীদের প্রতিবেদন রচনায় উৎসাহিত করার লক্ষে ১৯৯৯ সাল থেকে দুর্নীতি বিষয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার কার্যক্রম চালিয়ে আসছে টিআইবি। ২০১২ সাল পর্যন্ত মোট ৪৬টি পুরস্কার প্রদান করেছে। জাতীয় প্রিন্ট মিডিয়া, স্থানীয় প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এ তিন বিভাগে প্রত্যেক বছর পুরস্কার প্রদান করছে। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রতিবেদকের পাশাপাশি ক্যামেরাপার্সনকেও পুরস্কার প্রদান করছে তার সাহসী ভূমিকার জন্য।
শুধু উৎসাহ দেয়াতেই থেমে থাকেনি এর কার্যক্রম, চলছে দক্ষতা ও সংবেদনশীলতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা। দেশের সাতটি বিভাগেই স্থানীয় সাংবাদিকদের জন্য আয়োজন করেছে দুর্নীতি বিষয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা প্রশিক্ষণ। এ আয়োজনে সাড়া দিয়ে সারাদেশের প্রায় দেড়শতাধিক সাংবাদিক অংশ নিয়েছেন সেসব প্রশিক্ষণে। ভবিষ্যতেও এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে সাংবাদিকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তার জন্য।
দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রমকে আরোও এগিয়ে নিতে ২০১২ সাল থেকে টিআইবি শুরু করেছে দুর্নীতি বিষয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ফেলোশিপ।এ কার্যক্রমের আওতায় প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এ দুই বিভাগেই ফেলোশিপ প্রদান করা হয় দ’ুজন সাংবাদিককে।
টিআইবি’র মতো আরোও কিছু প্রতিষ্ঠান এ ধরণের সহযোগীতা দিচ্ছে গণমাধ্যমকে। কিন্তু এই কি যথেষ্ট? না শুধু সাংবাদিকদের দক্ষতা বাড়ানো নয় সেইসাথে গণমাধ্যমের জন্য তৈরী করতে হবে মুক্ত পরিবেশ। থাকতে হবে তথ্যের অবাধ প্রবাহের সুযোগ। তথ্য অধিকার আমাদের মৌলিক অধিকার। সাধারণ মানুষের কাছে নিরপেক্ষ সত্য তথ্য পৌঁছানোর যে মহান দায়িত্ব গণমাধ্যমের কাঁধে রয়েছে তার যেন ব্যত্যয় না হয় সেজন্য বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ মেনে নিয়ে সাংবাদিকদের কাজ করে যেতে হবে, সাহসিকতার সাথে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য দিয়ে জনগণের সামনে সত্য উন্মোচন করতে হবে। সংবাদমাধ্যমকে অবশ্যই স্বাধীন ও নির্দলীয়ভাবে কাজ করতে হবে।
বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির যে প্রভাব গণমাধ্যমের উপর দেখতে পাই তাতে যেমন খর্ব হচ্ছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা তেমনি বন্ধুর হচ্ছে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ। সেইসাথে সংকুচিত হচ্ছে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পথ। সকল বাঁধা অতিক্রম করে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে এগিয়ে নিতে হবে। তাই আজকের গণমাধ্যমের শ্লোগান হোক-
‘সাংবাদিকতায় সততা ও শুদ্ধাচার
গণতন্ত্র, সুশাসন, জবাবদিহিতার অঙ্গীকার’
Add comment