নোবেল! বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানিত পুরষ্কার যা ৬ টি খাতে দেওয়া হয়, যার ৪ টিই মূলত গবেষণা কাজের জন্য বরাদ্ধ (পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসা শাস্ত্র ও অর্থনীতি)। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে একমাত্র নোবেল বিজয়ী ব্যক্তি ড. মুহাম্মদ ইউনুস (শান্তিতে)। যাজ্ঞে, নোবেল পাওয়ার মত বড় সড় গবেষণার কথা ছেড়ে সাধারণ গবেষণার আসি। বিশ্বে এখন গবেষণা বলতে ওয়েব সায়েন্স আইএসআই সাইটেড বা স্কুপাস ইনডেস্কট পাবলিকেশন্সগুলোকেই বুঝায়। নেচার ইনডেক্স অনুযায়ী ২০১২ সাল হতে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত গবেষণা পত্রের সংখ্যা যথাক্রমে ৬, ১১, ১৪ ও ২২! যেখানে শুধুমাত্র ২০১৫ সালে চায়না ৯৫৬০ টি, জাপান ৪৫৪৭, সাউথ কোরিয়া ৮৯০, তাইওয়ান ৯২৪ টি ও ভারত ১৫২১ টি গবেষণা আর্টিকেল প্রকাশ করে! সর্বশেষ তালিকায় দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের গবেষণা পত্রের সংখ্যা ৮ টি যার প্রায় ২২ শতাংশ গবেষক বাংলাদেশী ও বাকীরা বিদেশী! বিশ্বনন্দিত কিন্ত নিজ দেশে বঞ্চিত বাংলাদেশী এক প্রফেসরের জবানীতে, “শুধুমাত্র আমার কাজগুলো ব্যতীত বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত গবেষণা পত্রের সংখ্যা ৬ থেকে ৮ টি”।
আমি সদ্য গ্রাজুয়েট। স্বল্প অভিজ্ঞতা তবে স্বপ্ন বেজায় বড়দূর। গত একবছর প্রফেশনালি গবেষণার কাজে যুক্ত হলেও টুকিটাকি কাজের ঝুড়ি একটু লম্বাই বটে। হয়তো সেই ক্ষুদে অভিজ্ঞতা থেকেই লিখতে বসা। বিভিন্ন অধিদপ্তর ও মন্ত্রনালয়েও টুকিটাকি দৌড়িয়েছি, দেখেছি সরকারি লেবেলে গবেষণার ধরণ ও মুল্যায়ণ। ওনাদের কাছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গবেষণা মানে ১ লাখ টাকা থেকে শুরু করে ১০ লাখ পর্যন্ত ফান্ডিং যা অনুমোদনের পর গবেষক পাবেন অর্ধেক আর বাকী অর্ধেক গবেষণা স্যাংশনের জন্য উর্ধতন কর্মকর্তা! ব্যাস, গবেষণা চলছে, গবেষণা পত্র জমাও হচ্ছে, আর নেহায়েত বছর ১/২ ইক পর পেপারগুলোকে ডাম্পিং করা হচ্ছে।
এনজিও লেবেল বেশ কিছু সংস্থা প্রশংসনীয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের মাঝে টিআইবি, ব্র্যাকের বিআইজিডি, নাগরিক উদ্যেগ, ব্লাস্ট ও এক্টিভ সিটিজেন্স অন্যতম। এই সকল সংস্থা থেকে প্রকাশিত রিপোর্টগুলোর ডিসেমিনেশন প্রশংসনীয়। বাকী সংস্থাগুলোও টুকিটাকি কাজ করে যাচ্ছে। তবে তাদের কর্মপরিধি মাঠকর্ম ও রিপোর্টের প্রয়োজনেই সীমাবদ্ধ ও ডিসেমিনেশনও অপ্রত্যক্ষ।
গত সেশনে দেশের মোট ১৩২ টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫২ টিতে একটাকাও গবেষণা খাতে খরছ করা হয়নি! বাকী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ৮৮ কোটি টাকা খরছ দেখানো হলেও ডিসেমিনেশন অপ্রত্যক্ষ। একাডেমিক গবেষণাগুলো খুবই নাজুক। ছাত্রাবস্থায় গবেষণা মানেই ঘরে বসে প্রশ্নপ্রত্র পূরণ করে রিপোর্ট তৈরি! আবার সেই রিপোর্টগুলোতে টুকিটাকি হাত চালিয়ে শিক্ষক জাতি নিজস্ব জার্নালে নিজের নামে প্রকাশ করে প্রমোশন হাকিয়ে নিচ্ছেন। বাংলাদেশে যে পরিমান প্রফেসর আছে তা গোটা ইউরোপীয় ইউনিয়নকেও হার মানাবে তবে বিশ্বে পরিচিত স্বদেশীয় প্রফেসারের সংখ্যা হাতে গোনা বড়জোর ডজন খানেক। আইএসআই বা স্কুপাস ইন্ডেক্সে বাংলাদেশ থেকে কোনো পেপার সাবমিট হলে [এই ডজন খানেক প্রফেসারের পেপার ব্যতীত] প্রথমেই রিভিউয়ার নির্দিদ্ধায় রিজেক্ট করে দেন। এটা শুধু আমাদের ঘরে বসে গবেষণা করার ফলশ্রতি। আর তাই আমাদের বৎসরে ইন্ডেক্স আর্টকেলের সংখ্যাও ১২ থেকে ১৫! আবার এই জাতি গড়ার কান্ডারি ও দেশের রুপরেখা বিনির্মানের ভূত শিক্ষক কাম গবেষক নিয়োগেও রয়েছে জালিয়তি। কেউ কেউ টাকার বিনিময়ে, আবার কেউ কেউ রাজনৈতিক করমোর্দনে বা সেক্সপিয়রের কর্ম বা জীবনানন্দ দাশের জন্মস্থান জিজ্ঞেসের মধ্য দিয়ে মূল্যায়ন করছেন তাদের মেধা!
দেশের চলমান চাকুরীর বাজারকে কেন্দ্র করে ও গবেষণা খাতে প্যশন নিয়ে তরুণদের অনেকেই গতানুগতিক রুপরেখা থেকে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছেন অথচ শুধুমাত্র বিরুপ পরিবেশ, গবেষণাকে নিম্ন মানের কাজ বা ফান্ড খাওয়ার কাজ হিসেবে চিহ্নিত করে রাখার কারণে অধিকাংশ তরুণই বাস্তবতার নিরিখে পুনরায় ঝুঁকে যাচ্ছেন সরকারী চাকুরীতে বা চাপা ব্যথা নিয়ে পরিবার পরিজনদের ছেড়ে পাড়ি জমাচ্ছেন পরদেশে। ভালো প্রফেসাররাও টিকতে না পেরে বাইরের দেশে সুযোগ পেলে হাত ছাড়া করছেন না। এভাবেই আমাদের মেধা আলোকিত করছে পরদেশের জ্ঞানভান্ডার, আমরা মুখের জোর নিয়েই বেড়ে চলছি বছরের পর বছর। আশায় বুক বাধি, একদিন ঘুমের ঘোর ভেঙে যাবে সরকারী পর্যায়ে, বিশাল ফান্ডিং বরাদ্দ হবে গবেষণায়, গবেষকদের মূল্যায়ন করতে শিখবে দেশ ও জাতি, স্বজাতীয় তরুণ গবেষকরা দেশে ফিরবে, মেধা কাজে লাগিয়ে গবেষণা নির্ভর উন্নয়ন প্রকপ্ল প্রণয়ন করে টেকশই উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে, বদলে দেবে দেশের উন্নয়নের রুপরেখা। আঠারো নেমে আসুক পলিসি মেকারসদের মাঝে।