১০ অক্টোবর পূজার ছুটি থাকায় কোন কাজ নেই, উদ্দেশ্য শুধু ঘুমাবো। কিন্তু সকালেই শ্বশুরের ফোন, কথার সার সংক্ষেপ, তাঁর জমির দাখিলা কাটা দরকার, ইউনিয়ন ভূমি অফিসের নায়েবরা প্রচুর ঘুষ দাবী করে, তাঁর সাথে আমাকে ভূমি অফিসে যেতে হবে। আমিও রাজি হলাম, প্রথমত আমাকে মোটামুটি চিনে, অফিসের কাজে দু’দিন গিয়েছি ভূমি অফিসে, দ্বিতীয়ত ঐখানে যারা প্রতিনিয়ত যাতায়াত করেন তারাও আমার কাজের ক্ষেত্র সম্পর্কে জানে, তৃতীয়ত নায়েব আমার এক আত্নীয়ের দূর সম্পর্কের আত্নীয়। অতএব, ঘুষ চাওয়ার প্রশ্ন-ই ওঠে না।
ঘুম বাদ দিয়ে শ্বশুরের অপেক্ষা করতে লাগলাম, বাজারে গিয়ে নায়েব সম্পর্কে সামান্য ধারণা আবারও নিলাম, যদিও জানি উনি টাকা ছাড়া খুব কম জিনিস-ই চিনেন। অফিসে গিয়ে দেখি এক নারী এবং এক পুরুষ বসে আছেন। নারীর কাজ প্রায় শেষ, উনি নায়েবের পরিচিত, তবুও এত কোমল আর সৌখিনভাবে কলম ধরে লিখছেন, যেন কলমে ব্যথা না পায় পাশাপাশি কালক্ষেপনও যে তার উদ্দেশ্য তা বুঝতে বাকি রইল না। তার কাছ থেকে টাকা নিলেন, জানি না কিসের টাকা। এরপর ঐ পুরুষকে বললেন আপনার কি কাজ? উনি কাগজ দেখালেন, নায়েবের উত্তর এ জমি নিয়ে সরকারের সাথে মামলা আছে। মামলা শেষ হোক, কয়েক দিন পরে আসেন তখন দেখা যাবে। লোকটি কোন একজনকে ফোনে ধরিয়ে দিলেন, হেসে হেসে কথা বলা শেষে বললেন, আপনি বসেন। আমি পরিচয় না দিয়ে আমার আত্নীয়কে ফোন দিয়ে বললাম, আপনার আত্নীয়কে বলেন আমার কাছে ঘুষ না চাইতে। উনি বলে দিলেন। নায়েব দাগ, খতিয়ান দেখে বললেন এখানে সব পাওয়া যাচ্ছে না, আপনি সব নিয়ে পরে আসেন।
শুনে শ্বশুর বাইরে বের হলেন ফোনে কথা বলার জন্য, এই সুযোগে আমিও বাইরে এসে দাঁড়ালাম দরজার কাছে। ঐ লোকটির কাছে ১,০০০ টাকা ঘুষ চেয়ে বসলেন নায়েব। লোকটি ৫০০ টাকা দিলে, উনি ফিরিয়ে দিতে উদ্যোত হতেই লোকটি আরো ১০০ টাকা দিলেন। তারপর নায়েব আরো ১০০ টাকা চেয়ে নিলেন। অবাক দৃষ্টিতে দেখলাম শুধু, শ্বশুর তার ভাইয়ের সাথে কথা বলো শেষে ফিরে আসলেন এবং আমাদের নায়েব ছুটি শেষ হওয়ার পরে সব কাগজ নিয়ে যেতে বললেন।
ছুটি শেষের পরে একদিন শ্বশুর গিয়ে পিয়নকে দিয়ে কয়েকটি খতিয়ান নম্বর বের করায় ৫০ টাকা দিতে হলো। কিন্তু নায়েব ঐদিন কাজ করে দিলেন না। বললেন লাগবে ২০,০০০ টাকা, আপনি হাজার দশেক নিয়ে আসবেন। বের হয়ে আমাকে ফোনে জানালেন, আমি বললাম রশিদ দিলে দশ হাজার না পনের হাজারও দিতে পারেন। আর রশিদ না দিলে দশ পয়সাও দেওয়া যাবে না। পরের দিন আবার গেলে পিয়ন ৩০০ টাকা নিলেন পর্চা দেওয়ার কথা বলে। কিন্তু পর্চা দেওয়ার কাজ ইউনিয়ন ভূমি অফিসের না, ডিসি অফিস পর্চা দিবে, যা তিনি জানতেন না। তাছাড়া ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে যোগাযোগ করলে, ডিসি অফিসের পর্চা পাওয়া যাবে মাত্র ৫০ টাকায়, তাও তিনি জানতেন না।
পরবর্তীতে আরো একদিন গেলে পিয়ন পর্চা না দিয়ে, বসিয়ে রেখে চা খেতে যেয়ে ঘন্টার মধ্যে না ফেরায় শ্বশুর ফিরে আসেন। এবং বলে আসেন, যদি দাখিলা কাটার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারি তবেই আসবো। সাথে সাথে বিষয়টি আমাকে জানালেন। আমি ইউএনও মহোদয়কে জানালাম এবং এও জানালাম যে, যা খাজনা আসে তা দিতে আমরা প্রস্তুত। ইউএনও মহোদয় কাগজ দেখে সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানান। কিন্তু একটি কথা শুনলাম যে, এক লোকের তিন শতক জমির জন্য নায়েব ৩,০০০ টাকা ঘুষ নিয়েছেন আমার শ্বশুরের সামনে।
আমরা সাধারণ মানুষেরা যাবো কোথায়? যারা জমি সম্পর্কে বুঝি না, তারা কি সব সময় এই নায়েব নামক সরকারি চেয়ারে বসা দানবের ভয়াল থাবা সহ্য করবো, নাকি অন্য কিছু? আমরা আমজনতা তো ভূমি আইন সম্পর্কে কিছুই জানি না। সিটিজেন চার্টার থাকা স্বত্ত্বেও আইনের ফাঁকে আমাদের ঢুকিয়ে আখ মাড়ায়ের যন্ত্রের মতো আমাদের পিষে মারছে এই দানবগুলো। এর শেষ কোথায়??