বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রোভাইস চ্যান্সেলর অ্যপয়েন্টমেন্ট দেবার কথা হলো। সবার মাঝে সর্বাগ্রে ছিল সাজ্জাদ সাহেবের নাম। দায়িত্ব ঠেকলো ভাইস চ্যান্সেলর মাহমুদ হোসেন এবং প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক স্যারের কাছে। দুই জনেই দুইটা আলাদা লিষ্ট তৈরি করলেন কিন্তু দুইটা লিষ্টেই সাজ্জাদ সাহেবের নাম ছিল দুই নাম্বারে! পরষ্পর পরষ্পরের কাছ থেকে কারন জানতে চাইলে দুইজনই একই কারন দর্শান, “সাজ্জাদ লেইকস চ্যারিটি”!
ভিন্ন কথায় আসা যাক। শুনেছি রাজ্জাক স্যার নাকি সারাজীবন লেকচারার থেকে গিয়েছিলেন, প্রমোশনের জন্য অ্যাপ্লিকেশন করার সময় পাননি। বর্তমান সময়ের চিন্তা চর্চাবিদ আহমদ ছফাকে জাতির জনক রাষ্ট্রপতি হবার সুযোগ দিতে চাইলে জবাবে বলেছিলেন আপনার মন্ত্রিসভার আমাকে রাষ্ট্রপতি বানানোর মত দম নেই! কেমন জানি কথাগুলো শুনলেই অনেকে ভাবতে পারেন উনারা অনেক উঁচু মাপের মানুষ, তাই প্রসঙ্গ পরিবর্তন করছি।
আমার কিছু শিক্ষকের মুখে শুনা ওনাদের শিক্ষকের গল্পগুলো ছিল এইরকম- ঘটনা-১: পরের দিন পরীক্ষা, বিকেলে বাজার করতে গেলাম। বাজার শেষে ফেরার সময় পথিমধ্যে আমি দূর থেকে স্যারকে বাজারে আসতে দেখলাম, আর স্যারও আমাকে দেখলেন। ব্যাস, আমি দিলাম মাঠের দিকে দৌড় আর স্যারও সাইকেল ফেলে আমার পেছনে লাগলেন, আমাকে ধরে শাসন করে বাসায় পাঠালেন! ঘটনা-২: বাংলা পড়াতে গিয়ে সমাস নির্ণয়ে আমার শিক্ষক একটা শব্দে আটকা পড়লেন। উনার বাসা থেকে পন্ডিত মহাশয়ের বাড়ীতে যাওয়ার পর প্রথমদিন বাজারে, পরেরদিন মাঠে থাকায় তৃতীয়দিন শব্দখানা পণ্ডিত মহাশয়ের কাছ থেকে শিখে চতুর্থদিন আমাদের শিখিয়েছিলেন! ঘটনা-৩: আমার সুপারভাইসরকে গবেষনা কর্ম সঠিকভাবে সম্পাদন করার নিমিত্তে কিছু বই রিকমেন্ড করতে বললে উনি লাইব্রেরি দেখিয়ে দিয়ে প্রতিউত্তরে বলেছিলেন, ‘মাই বয়, গো টু দ্যা লাইব্রেরি অ্যান্ড সোক’!
বর্তমানের কালের ঘটনাগুলো ঠিক তার উল্টো। ঘটনা-১: আমার ওমক শিক্ষক ক্লাসে কি লেকচার দেন নাকি পলিটিক্যাল ভাষন দেন, বুঝবার পারিনা! ঘটনা-২: ওমক স্যারকে বললাম, স্যার আপনার লেকচারের এই অংশটুকু বুঝতে পারিনি, জবাবে উনি ওনার রুমেএ দেখা করতে বললেন। দেখা করলে আলাপচারিতা শেষে বললেন যোগাযোগ রাখার জন্য। পরীক্ষা শেষে ডেকে নিয়ে ওনার একগাদা কাজ ধরিয়ে দিয়ে বললেন জত তাড়াতাড়ি পার জমা দিয়ে দিও, আর তোমার রুল নং টা যেন কত!! ঘটনা-৩: আমি আজ খুবই খুশি! পলিটিক্যাল প্রোগ্রামএ যাওয়ার পর অমুক শিক্ষকের সাথে দেখা। বিভিন্ন কথা শেষে আমার রেজাল্ট জেনে খুবি খুশি হলেন এবং ভবিষ্যৎতে নিজের স্থলাভিষিক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যোগাযোগ রাখতে বললেন।
ছোটবেলায় প্যারাগ্রাফে পড়েছিলাম, ‘টিচিং ইজ অ্যা নোবল প্রফেশন’, আজ শিক্ষকতা পেশায় কি সেই ‘নোবল’ শব্দটা বিরাজ করে? বিরাজ না করলে কেনইবা করেনা? জাতি গড়ার কাণ্ডারীদের কি এতটাই পরিবর্ত্ন আনিবার্য ছিল? শিক্ষকতাকে সপ্নের পেশা হিসেবে আমার এক শিক্ষকের কাছে অভিব্যক্ত করলে আমাকে প্রতিউত্তরে বলেছিলেন, ‘সবকিছুতে ব্যার্থ হলে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিতে পারো’! নিজের পেশার প্রতি নিজেরই এতটা বিতৃষ্ণা কেন! তখনি মনে পড়ে গেল আরেক প্রফেসারের বিখ্যাত উক্তি যিনি দুঃখভরাক্রান্ত হৃদয়ে বলেছিলেন, ‘একজন সচিব গাড়ী পার্কিং এর জন্য যেই পারিমান টাকা পান তা প্রায় আমার বেতনের সমান’!
সময়ের সাথে সাথে মানুষের চাহিদাও পাল্টেছে। সবাই ভালো একটা স্ট্যটাস চায়। আর পাওয়ার নামক শব্দটি আমাদের কালচার এর সাথে মিশে গেছে, থাকলে গেইনার আর না থাকলে লুজার! হয় রীতিসিদ্ধ প্রথা পরির্তন করুন না হয় ওনাদেরও সুযোগ করে দিন। গায়ের জোরে বলে দিতে পারেন উনারাও সচিব হোক! আসলে তাই কি হচ্চেনা? ভার্সিটির আঙ্গিনায় ঘুরলেই অবলোকন করতে পারবেন যেই ছেলেটা ফাষ্টক্লাস ফাষ্ট হবার যোগ্যতা রাখে, সে প্রথমবর্ষ থেকে ব্যকবেঞ্চার হয়ে বিসিএস এর প্রস্ততি নেয়। কেউবা মেধার প্রখরে ফাষ্টক্লাস পজিশনধারী হলেও শিক্ষক নিয়োগে রাজনৈতিক উচ্চলম্প দৌড়-ঝাপ দেখে উচ্চ শিক্ষার নামে বিদেশ বনে যান।
শিক্ষক নিয়োগতো থেমে নেই! তাইলে কারা নিয়োগ পাচ্ছেন এই মহৎ পেশায়? হুম, উনারাই পাচ্ছেন যারা সেই পলিটিক্যল লেকচারগুলোকে হজম করতে পেরেছেন, বই কিংবা আর্টিকেল লেখার কাজগুলো দ্রুত জমা দিয়ে নাম্বার তুলে নিতে পেরেছেন, অথবা পলিটিক্যাল প্রোগ্রামে পরিচিত হবার পর দীর্ঘসময় যোগাযোগ রক্ষা করতে পেরেছেন। জী, পরবর্তীতে ওনাদের পিএইচডি প্রতিবেদনই কপি-পেস্ট এর দায়ে আটকা পড়ে, মুক্তচিন্তার পথ রুদ্ধ হয়ে আসে, দেশ মেধাশুন্যতার দিকে ধাবিত হয় এবং জাতি নেতৃত্ব হীনতায় ভুগে। অন্যদিকে হাতেগুনা যেই দুই-চারজন মেধার জোরে নিয়োগ পান, তারাও সেই কপি-পেষ্ট ওয়ালাদের মেধার কাছে টিকে থাকতে পারেননা। হয় তাদের কোনঠাসা হয়ে থাকতে হয় নতুবা হায়ার ষ্টাডির আর গেষ্ট টিচার হিসেবে বাইরেই জীবনটা কাটিয়ে দিতে হয়। এভাবেই বঞ্চিত হচ্ছে নিজ দেশ, সমৃদ্ধ হচ্ছে পরের গ্রন্থাগার আর গবেষণাগার! বছরের পর বছর নিজ দেশ চলছে বিদেশি টেক্সট বুক দিয়ে, আর পরদেশে হচ্ছে ইন্ডিজেনাইজেশন্স অব নলেজ! এভাবে কোনো জাতি চলতে পারেনা, মুখ থুবড়ে পড়বে সকল উন্নয়ন। শুভবুদ্ধির উদয় হোক। শুধু বলবো, রাত পোহাবার কত দেরী পাঞ্জেরী!!!