কোন একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলেন আপনি বিছানা নয়, রক্তের বাথট্যাবে শুয়ে আছেন। আপনার চারপাশ তাজা রক্তে টইটুম্বুর। রক্তের হাত থেকে বাঁচতে ওঠে দৌড় দিলেন, জুতা পরার সময় নেই। দ্রুত বেসিনের ট্যাব ছাড়লেন, রক্ত মাখা মুখমন্ডল পরিষ্কার করবেন। কিন্তু আপনি ট্যাবের পানির দিকে না তাকিয়ে, তাকিয়ে আছেন আয়নায়। আপনি দেখছেন রক্তমাখা আপনার বিভৎস চেহারা। যে প্রতি সপ্তাহে গোলাপ জলে স্নান করে, দামী পারফিউমের ঘ্রাণে চারপাশ জেগে ওঠে, সেই আপনার শরীর থেকে বিশ্রী রকমের দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। দেখছেন আর ভাবছেন, এসব কিসের আলামত? ভাবতে ভাবতে হাত পেতে ট্যাবের পানি নিয়ে মুখে ছিটালেন, মুখে লাগতেই ভয়ে কেঁপে উঠলো আপনার শরীর। এতো পানি নয়, তাজা রক্ত। এতো রক্তে কোথা থেকে আসলো, প্রশ্ন আপনার মনে।
ভাবলেন, এভাবে কাজ হবে না। শাওয়ার ছাড়লেন সারা শরীর ধুঁয়ে ফেলবেন, এই আশায়। কিন্তু না, এখানেও পানির বদলে রক্ত, তাজা নয়, দুর্গন্ধযুক্ত পঁচা রক্ত। সারা শরীরে সেই রক্ত লেগে একাকার। এতক্ষণে মাথায় আসলো আপনার, এই বাড়িতে আপনি একা নয়। এখানে আরো আছে আপনার প্রিয় স্ত্রী, সাত বছর বয়সী একটি ছেলে ও চার বছরের মেয়েটা।
দৌড়ে ছুটলেন মেয়ের ঘরে, ঘুমিয়ে আছে জমাট বাঁধা রক্তের উপর মাথা রেখে, জড়িয়ে আছে জমাট বাঁধা একটি রক্তের পুতুল। না, আপনি সহ্য করতে পারছেন না।
দৌড়ে পালানোর রাস্তা নেই, ছেলে এবং স্ত্রীর কি অবস্থা? স্ত্রীর কাছে যেতেই দেখলেন রক্তের বিছানায় শুয়ে আছে, গলায় ও হাতে বিষধর সাপ প্যাঁচানো। এ কি রক্তের সাথে সাথে সাপের উৎপাত। আবার ছুটলেন, ছেলের ঘরে ঢুকে দেখলেন রক্তের ভিতর ডুবে আছে আপনার প্রাণ প্রিয় সন্তান। যে ছেলেকে নিয়ে আপনার প্রচন্ড আশা। যে আপনার মুখ উজ্জল করবে, যে আপনার মতো সরকারী বড় কর্তা হবে, যে হবে আপনার ভবিষ্যতের অবলম্বন, সে কি না ভাসছে রক্ত স্রোতে। না, আর কোন কিছু আপনি ভাবতে পারছেন না, জ্ঞান হারিয়েছেন।
ঘোরের মধ্যে দেখলেন কেউ একজন বলছে, তুমি তোমার মাকে তিল তিল করে হত্যা করছো, প্রতি নিয়ত তার রক্ত পান করছো, রক্তের বিনিময়ে স্ত্রী গয়না তৈরি করেছো - যা আজ সাপে পরিণত হয়েছে, সন্তানদের সেই রক্ত দিয়ে মানুষ করছো, আজ সেই রক্ত সব বেরিয়ে আসছে। বলেই সে লোক উধাও।
আপনি ভাবলেন, ধূর ছাই, কি দেখলাম। সব বাজে কথা। আমার জীবনের সবচেয়ে সম্মান ও শ্রদ্ধা করেছি আমার মাকে। একটু কাশি হলেও এদেশে না ভারত ডাক্তার দেখিয়েছি। শেষ পর্যন্ত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর পর্যন্ত নিয়েছি, সেই মা'র রক্ত আমি পান করেছি! অসম্ভব কথা, সব বাজে চিন্তা মাথায় ভর করছে। এসব যখন ভাবছেন, তখনও আপনার শরীরে রক্ত, দুর্গন্ধ।
আপনার অন্য মন বলছে, মায়ের সাথে কি কোন বেয়াদবি করছি। কেমন করে ক্ষমা চেয়ে নিবো, গত বছর মা মারা গেলেন। তিন হাজার লোকের আয়োজন করে মেজবান খাওয়ালাম, সেই মায়ের রক্ত, না, এটা হতে পারে না। ভাবতে ভাবতে অপরিষ্কারভাবেই বেরিয়ে পড়লেন, উদ্দেশ্য মায়ের কবর। জিয়ারাতের উদ্দেশ্যে হাত তুলেছেন, চোখ বন্ধ। দেখলেন আপনার মা আপনার সামনে, সে বলছেন - তুই প্রতি নিয়ত অসহায়-গরীবের কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছিস, তাদের রক্ত চুষে বাড়ি-গাড়ি করেছিস, অবৈধ টাকায় সংসারের খরচ চালিয়ে আরাম-আয়েশ করছিস, স্ত্রী-সন্তানদের আরামী জীবন দিয়েছিস কিন্তু এই দেশটা তো মায়ের মতো। মায়ের মতো কি, এটা তো মা। এই দেশ মা তোকে সব দিয়েছে, আর প্রতিদিন তিল তিল করে তাঁর রক্ত ঝরিয়ে মৃত্যুর দ্বার প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছিস। যে দেশ মাকে ভালবাসতে জানে না, সে তো মানুষ নয়, তুই আমার সন্তান ভাবতেই আমার লজ্জা লাগে।
আপনি চোখ খুললেন, ভাবছেন বড় কর্তা ব্যক্তিরা তো ঘুষ খায়, তবে আমার বেলায় কেন এমন হলো। প্রতিজ্ঞা করলেন, আর অবৈধ আয় নয়। শপথ করে বললেন। ভাবলেন যে খারাপ কাজ করে সে খারাপ মানুষ, আর যে খারাপ কাজ করে অনুতপ্ত হয় এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে, সে তো খারাপ নয়।
হঠাৎ মেয়ের বাবা ডাকে ঘুম ভাঙ্গল আপনার। জেগে দেখেন কিছুই ঘটেনি। যা দেখেছেন, সব স্বপ্ন। তারপরও মনে মনে ভেবে নিলেন, আর নয় অবৈধ আয়, আর নয় দুর্নীতি।
Comments
RSS feed for comments to this post