বাস্তবতা ছাড়া সাহিত্যের রস দিয়ে সুন্দর করে লেখা আমার কাজ না। সব সময় চেষ্টা করি যা দেখি, তাই লেখার। কেননা, আমার কল্পনার জগৎ খুবই সামান্য, কল্পনায় কিছু আঁকতে পারি না বলেই লিখতে পারি না।
মফস্বলে জন্ম ও বেড়ে ওঠা বলেই এখানকার সমস্যা ও সুবিধাগুলো খুব কাছ থেকে দেখছি। আমাদের পুরাতন দু'টি বাড়ির সামনে থেকে এবং নতুন বাড়ির সামান্য দূর থেকে চলে গেছে রূপসা-বাগেরহাট পুরাতন সড়ক। এই সড়ক এক সময় খাজা খানজাহান আলীর রাজ্যে প্রবেশের পথ ছিলো।
পূর্বে এই সড়কে ভ্যান, রিক্সা, টেম্পু, বাস চলাচল করলেও কালের বিবর্তনে টেম্পুর পরিবর্তে অটোরিক্সা (যা এখানে অটো নামে পরিচিত), ভ্যান-রিক্সা ব্যাটারি ও মটর সেট করে আধুনিক করা হয়েছে এবং বাসের পরিবর্তে মাহেন্দ্রা নামক এক যানের আগমন ঘটেছে। পাশাপাশি ট্রলি, নছিমন, করিমন নামক ভয়ানক গতি ও দুর্বল ব্রেক সম্পন্ন মালবাহী যানের উদ্ভব ঘটেছে।
এই ঐতিহ্যবাহী সড়ক বহু বছর অবহেলা ও অযত্নে পড়ে থাকার পর বেশ কয়েক বছর পূর্বে এখনকার এমপি'র আন্তরিক প্রচেষ্টায় পুনঃ নির্মাণ করা হয়। শোনা কথা, তার কয়েক বছর পর তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের এক নেতাকে সড়কের দুই পাশে মাটি দেওয়ার ঠিকা দেওয়া হয়। পুরো টাকাই পকেটস্থ করেছেন তিনি। এখন রাস্তার দুই পাশ ভেঙ্গে রাস্তা দিন দিন সংকীর্ণ হয়ে প্রতি নিয়ত দুর্ঘটনার জন্ম দিচ্ছে।
প্রথমে আসি অটোরিক্সার কথায়, হালকা এ যানে চড়তে আরামদায়ক হলেও এখানের যাত্রীরা সে সুযোগ মোটেই পান না। ভিতরে চার জনের স্থলে ছয় জন এবং সামনে এক জনের স্থলে দুই জনকে বসানো হয়। মাঝে মধ্যে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, যাত্রীরাও জেলখানার কয়েদীর মতো নির্বিকার বসে থাকে। কিছু বলার নেই, এদের রয়েছে ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় পরিচালিত সংগঠন। এরপর আবার রাস্তার পাশে গেলে উল্টে যাবার ভয় যাত্রীদের প্রতি নিয়ত তাড়া করে।
মাহেন্দ্রার গতি রকেটকেও হার মানায়। অতিরিক্ত গতি ও মাত্রাতিরিক্ত যাত্রী বহনের কারণে প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে। একজন মারা যাবার পর গতি কিছুটা কমে, মাঝে চার জনের স্থলে তিন জন বহন করে, কয়েক দিন পর যা তাই। এই মাহেন্দ্রার বেশির ভাগের লাইসেন্স নেই, যাদের লাইসেন্স আছে - তারা নম্বর প্লেট সামনে লাগায়। যাতে করে দুর্ঘটনার পর দ্রুত স্থান ত্যাগ করলে ঐ গাড়িকে শনাক্ত করা না যায়। এই মাহেন্দ্রার কোন ড্রাইভারের লাইসেন্স আছে বলে শুনি নাই।
নিয়মিতভাবে মাহেন্দ্রা দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে, পঙ্গুত্ব বরণ করছে। দেখার কেউ নেই। যখন যে দল ক্ষমতায় তখন সেই দলের নেতাদের ছত্রছায়ায় বাংলাদেশের পরিবহন সেক্টর, বাগেরহাটও এর ব্যতিক্রম নয়। নেতাদের ছত্র ছায়ায় শ্রমিক ইউনিয়ন করে যাত্রীদের অনেকটা জিম্মি করে রেখেছে। শোনা কথায় কান দিতে নেই, তারপরও না দিয়ে পারি না। শুনেছি যে, গাড়ি প্রতি মাসিক ছয়শত টাকা দিতে হয় প্রশাসনকে। জানি না, কাকে দেওয়া হয় এই টাকা। আমার মতো সাধারণ মানুষের জানার কথাও না।
নসিমন, করিমন গাছ পরিবহন ও মানুষ বহনের কাজ করে। হুটহাট ইচ্ছা মতো উল্টে যায় এই গাড়ি, কারো অনুমতি নেয় না। ড্রাইভার এতো চৌকস যে, লিংক রোড থেকে মেইন রোডে উঠার সময় কোন কিছুর তোয়াক্কা করে না। একমাসও হয় নি, এখনো রক্ত শুকায় নি মুরগী পালন কেন্দ্রের সামনে নসিমন ও মাহেন্দ্রা দুর্ঘটনায় দুটো তরতাজা প্রাণ গেল।
একদিন দাঁড়িয়ে আছি, এলজিইডির মোড়ে, আছেন একজন ট্রাফিক সার্জেন্টও। একটি নসিমন তাকে ক্রস করার সময় ড্রাইভার দুটো পাঁচ টাকার নোট ট্রাফিক সার্জেন্টকে দিতে গিয়ে নিচে পড়ে গেল। নসিমন চলে গেল, ট্রাফিক সার্জেন্ট পিছনে মোটর সাইকেল তা তার চিন্তায় নেই, দৌড়ে ঐ টাকা তুলতে গেল। মনে মনে ভাবছি, শালা গাড়ির তলে পড়। এইভাবেই এই ভয়াবহ গতি সম্পন্ন ও দুর্বল ব্রেকের গাড়ি চলছে তো চলছে।
ট্রলি চলে সাধারণ কন্সট্রাকশনের মালামাল বহনের জন্য। এই ট্রলিরও একি অবস্থা। রকেটের চেয়েও তিনগুণ গতিতে চলতে গিয়ে কখনও খালে, কখন বডি রেখে ইন্জিন নিয়ে ড্রাইভার নালায়, কখনও অন্য গাড়ির উপর তুলে দেয়। এই বহনের ড্রাইভার বয়স সাধারণত তের থেকে বিশের ভিতরে। এরা সিগারেটের পাশাপাশি সিদ্ধি (গাঁজা) খাওয়ায়ও সিদ্ধ। এদের নিয়ন্ত্রণের কোন ব্যবস্থা নেই।
নিজের অভিজ্ঞতায় আসি, প্রতি বছর ঈদের সময় অস্বাভাবিক হারে টিকেটের মূল্য বাড়ে। মন্ত্রী থেকে শুরু করে পাতি নেতারাও এটা নিয়ন্ত্রণে বক্তব্য দিলেও কাজ তেমন একটা হয় না। শহর অঞ্চলে দৃশ্যমান দুই-একটা ব্যবস্থা নিলেও মফস্বল সর্বদা অবহেলিত থাকে। এই ঈদের নয় দিন পরে যাত্রাপুর থেকে ঢাকা যাওয়ার টিকেট ৩৫০ টাকার স্থলে ৫০০ টাকা রেখে কাউন্টার থেকে বললো পাশে বলে না। আমি যা বুঝলাম এবং জানলাম, অন্যদের কাছ থেকে এরচেয়েও বেশি নেওয়া হয়েছে।
মন্ত্রী মহোদয় রাত-দিন ছুটছেন সড়কের উন্নয়ন ও নিরাপত্তা দিতে, কিন্তু সেটা শহর কেন্দ্রিক, মফস্বলে নজর দেওয়ার সময় এসেছে। আমরা আমাদের স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চাই, আমরা লাইসেন্সবিহীন ড্রাইভার ও গাড়িতে জীবন বিসর্জন দিতে চাই না। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় এটা ভাবতে চাই, ভালভাবেই ফিরতে পারবো। দুর্ঘটনা এক ব্যাপার আর অন্যের খামখেয়ালীপনায় মৃত্যুতো খুনের সমতুল্য।
Comments
RSS feed for comments to this post