আলোকবর্তিকার জন্ম থেকে আমাদের সকলের ইচ্ছা ছিলো একটি বড় ব্লাড ডোনার গ্রুপ থাকবে। তার জন্য আমরা ফ্রী কয়েকটি ব্লাড গ্রুপিং ক্যাম্প করবো, যাত্রাপুর ইউনিয়নকে কেন্দ্র করে। নিয়মিত এই নিয়ে আলোচনা হতো, চেয়ারম্যানকে অনুমান করে জানালাম, প্রায় ত্রিশ/ চল্লিশ হাজার টাকা লাগবে।
এসব চিন্তার কিছু দিনের মধ্যে যাত্রাপুর ইউনিয়ন পরিষদে এলজিএসপি-২ এর আওতায় কিছু কার্যক্রমের একটি অনুষ্ঠান ছিল। এডিসি, ইউএনও, উপজেলার চেয়ারম্যান সহ বিভিন্ন প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক নেতারা উপস্থিত ছিল। অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে আলোকবর্তিকার লক্ষ্য তুলে ধরলেন চেয়ারম্যান, মাইক্রোফোন দেওয়া হলো আমার হাতে, যতটুকু গুছিয়ে বলা সম্ভব, ততটুকু বললাম। ইউএনও ও উপজেলার চেয়ারম্যান ঘোষণা দিলেন আমাদের ব্লাড গ্রুপিং-এ অনুদান দিবেন এবং পুরো ইউনিয়ন গ্রুপিং করার জন্য বললেন। আমরা রাজি, অনুষ্ঠানের এক ফাঁকে আমাকে ইউএনও উপজেলা পরিষদে দেখা করতে বললেন। দেখা করতে গেলে, একটি শর্ত জুড়ে দিলেন - কিশোরীদের তালিকা করে দিতে হবে, বাল্য বিবাহমুক্ত ইউনিয়ন করবেন। আমাদের সংস্থা মূলত অমুনাফাভোগী সামাজিক উন্নয়নের জন্য প্রতিষ্ঠিত, তাই এতেও রাজি হলাম। ইউএনও'র সাথে প্রথম পরিচয় হলো।
সময় কেটে গেছে প্রায় এক মাস। গ্রুপিং-এর কাজ শুরু হলো পরীক্ষামূলকভাবে। ডিসি ও ইউএনও আমাদের ব্লাড গ্রুপিং-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করলেন, দিক নির্দেশনামূলক কথা বললেন। চেয়ারম্যানের কাছ থেকে জানলাম, ইউএনও একজন সৎ মানুষ। তিনি নাকি একবার তেলের জন্য নারকেল কিনে পাঠিয়েছিলেন চেয়ারম্যানের কাছে। চেয়ারম্যান বলেছিলেন, নারকেল লাগবে না। তাঁরও সাফ উত্তর, তেল দেওয়া লাগবে না। সাধারণত, এমন অফিসাররা নাকি চেয়ারম্যানদের কাছ থেকে শুধু তেল না পার্সেন্টও নেয়। শুনে আশ্চার্য হইনি, আশাবাদী হয়েছি। হয়ত, সোনালী দিন উঁকি দিচ্ছে। সৎ মানুষের মাথা নত কখনও হয় না, সততায় আর ভাল মানুষে ভরে উঠবে আমাদের সোনার বাংলা। তারপর থেকে, ইউএনও শরীফ নজরুল ইসলামকে যতবার দেখেছি বা কথা শুনেছি ততই আশাবাদী হয়েছি।
রাজনীতির টোপে দিন দিন দেশের খালগুলো পুকুর বা ঘেরে পরিণত হচ্ছে। পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে, অনেক সময় মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ছে। কোন রাজনৈতিক বাঁধার তোয়াক্কা না করে, পানি প্রবাহ ঠিক রাখতে ও জলাবদ্ধতা নিরাসনে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে খাল কাটার নেতৃত্ব দিয়েছেন ইউএনও শরীফ নজরুল ইসলাম।
তিনটি ইউনিয়নকে বাল্য বিবাহমুক্ত ঘোষণা এবং বাল্য বিবাহ বন্ধে নিয়েছেন প্রসংশনীয় পদক্ষেপ। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, সভা-সেমিনারে বক্তব্যের সময় এই বিষয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন তিনি।
তাঁর যে কাজটির জন্য এই ব্লগ লেখা তা হলো, উপজেলা প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ। তিনি উপজেলার ১৩ টি সরকারি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারিকে দুর্নীতিবিরোধী শপথ করিয়েছেন। দুর্নীতিরোধের জন্য একটি কৌশল পত্র প্রনয়ণ করেছেন, যেখানে দুর্নীতিরোধে করণীয় ও মূল্যায়নের কৌশল ব্যাখ্যা রয়েছে। উপজেলার অফিসগুলোর দরজায় দায়িত্বপ্রাপ্ত তথ্য কর্মকর্তার নাম টানানো, অভিযোগ বক্স স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ, তথ্য কর্মকর্তাদের নাম, দপ্তর ও ফোন নম্বর দৃশ্যমান স্থানে টানানোর ব্যবস্থা করেছেন। টিআইবি অফিসে পরামর্শ সভা করেছেন। সাংবাদিক, চেয়ারম্যান, শিক্ষকদের সাথে পৃথক সভার ব্যবস্থা করেছেন। একটি জরিপও করেছেন - দুর্নীতির উপর। এসব দেখে সত্যই তাঁকে শ্রদ্ধা করি।
শেষ যে দিন দেখা হলো, আমরা তিনজন, বশির ভাই ও ইউএনও। তিনি বলেছিলেন, আমি কিন্তু তত ভাল না। খুবই রূঢ় একজন মানুষ। মোবাইল কোর্টে আইনের বাইরে কখনও যাই না, যদিও মোবাইল কোর্ট আপাতত কম করছি।
আমি মনে মনে ভাবছিলাম, এই রকম রূঢ় কিছু অফিসার দরকার, প্রতিটি সেক্টরে, প্রতিটি অফিসে। অনেকে ইনোভেটিভ অনেক কাজ করছে, প্রশংসিত হচ্ছে কিন্তু দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান নিতে কম মানুষকেই দেখা যায়, আর যদি হয় সরকারি কর্মকর্তা তবে তো আরও কম এই সংখ্যা। যখন প্রশাসন তথা সরকারি অফিসগুলো আকন্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত, মানুষ দুর্নীতির গ্রাস থেকে বাঁচতে খুঁজছে নানা পন্থা, দুর্নীতির কারণে যখন উন্নয়ন বাঁধাগ্রস্থ ঠিক সেই সময় স্রোতের বিপরীতে চলা একজন একজন সরকারি কর্মকর্তার জন্য আমাদের গর্ব হয়। আমাদের প্রার্থনা শুধু বাগেরহাট সদর উপজেলাতে দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান সৃষ্টি নয়, তাঁর ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্রগুলোতে তিনি দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান যেন সৃষ্টি করতে পারেন।
প্রতিটি অফিসার যদি দেশকে ভালবাসতে পারে, এই দেশটাকে নিজের ভাবতে পারে, ব্যক্তি স্বার্থের উর্দ্ধে দেশের স্বার্থকে রাখতে পারে, তবেই আমরা দুর্নীতিমুক্ত হতে পারবো।