ক্লাস সেভেন পর্যন্ত খুবই নিরীহ প্রকৃতির ছিলাম। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান বিধায় আম্মু ক্লাস সেভেন পর্যন্ত স্কুলে নিয়ে যেতেন আর নিয়ে আসতেন। এইটে একা আসা-যাওয়ার পাশাপাশি এক পাল বন্ধু জোটে, নেতা হওয়ার খুব শখ জাগে। যদিও বয়স বাড়ার সাথে সাথে সেই শখকে একটি ভুল ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না।
অষ্টম শ্রেণিতে একদল বন্ধু-বান্ধব নিয়ে চলি, এখানে-ওখানে আড্ডা মারি, কিছু দুষ্টমি করলেও কখনও বেয়াদবি করেছি বলে মনে হয় না। ঐ সময় কিছু বন্ধু জোটে যারা ক্লাসে ফাঁকি দিতো, পড়া পারতো না, সাধারণত শেষের দিকের বেঞ্চগুলোতে বসতো।
ওদের শিক্ষকের পিটুনীর হাত থেকে বাঁচানো বা পরীক্ষার সময় দেখানো - এগুলো আমরা কয়েকজন করতাম। বিনিময়ে ওদের থেকে কাজ করিয়ে নিতাম - যেমন দোকান থেকে এটা এনে দে, ওটা করে দে ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু এদের কারো ৮ম, কারো ৯ম বা সর্বোচ্চ এইচ.এস.সি. পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা হয়েছিল। যারা এস. এস. সি. বা এইচ. এস. সি. পাশ করেছিল, তাদের কেউ কেউ এনজিওতে চাকুরি বা ব্যবসা করেছিল। কিন্তু আন্ডার এস. এস. সি. - এর বেশির ভাগ রাজনীতি শুরু করে। কেউ কেউ সারা দিন মজুরের কাজ করে এসে সন্ধ্যায় মিছিল করে, এক কাপ চা পেয়ে খুশি হতে দেখেছি। এদের অনেকের বাড়ি ঠিকমত চুলা জ্বলে না, সে কিন্তু দলীয় মিছিলে চলে গেছে - নেতার হুকুমে।
রাজনীতি করতে হলে কোন যোগ্যতা লাগে কি না বা কোন নৈতিকতার ব্যাপার আছে কি না আমার জানা নেই। কিন্তু পর্যায়ক্রমে নেতার হুকুম মানতে মানতে, আর তেলের যথাযথ ব্যবহার করাতে আজ তারাও নেতা। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, বৃদ্ধ-যুবক, ধনী-দরিদ্র সমাজের সবাই ইচ্ছাতে হোক কিংবা অনিচ্ছাতে নেতা মানতে শুরু করছে। কারো কোন বিপদে বিশেষ করে মারামারি বা নারী ঘটিত ব্যাপারগুলোতে এদের দারস্থ হতে শুরু করলো, এদের আয়ের রাস্তা সম্প্রসারিত হতে শুরু করলো। দুই পক্ষের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে শুরু করলো বিচার, বিচার হয় অনেকটা বাঁনরের রুটি ভাগের মতো। আমজনতা ওদের পিছনে গালি দেয়, পর মুহুর্তে জ্বী হুজুর, জ্বী হুজুর শুরু করে।
এই মুহুর্তে একটা জোকস খুব আকারে মনের ভিতর উঁকি দিচ্ছে,
শিক্ষক এক ছাত্রকে বললো,
- তুই তো পড়াশোনা করিস না, পিছনে বসিস, তোরে দিয়ে হবে?
- স্যার আমি সমাজ চালাবো..
- কিভাবে?
- স্যার প্রথম সারির স্টুডেন্টরা পড়াশোনা করে কি করে?
- ডাক্তার, ইন্জিনিয়ার হয়।
- দ্বিতীয় সারির যারা, তারা কি করে?
- ব্যবসা-বাণিজ্য।
- তৃতীয় সারির গুলো পলিটিক্স এবং চতুর্থ সারির গুলো মাস্তানি. তাই তো স্যার?
- হুম। তাতে কি হয়েছে?
- প্রথম শ্রেণিকে ব্যবসায়ীরা চাকুরি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে, রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করে, আর ক্যাডার ও মাস্তানরা রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণ করে। কেননা, ক্ষমতায় যেতে হলে এবং টিকে থাকতে ক্যাডার লাগে। প্রকৃত পক্ষে, সমাজটাকে নিয়ন্ত্রণ করে চতুর্থ শ্রেণি। সেই প্রেক্ষাপটে, আমি সমাজের নিয়ন্ত্রক হবো।
এটা জোকস হলেও, বাস্তবতা এই দিকে ধাবিত হচ্ছে। মূর্খ, জঞ্জাল শ্রেণি সমাজের নিয়ন্ত্রকের আসনে বসতে মরিয়া। নষ্ট রাজনীতির সুযোগে সুযোগ সন্ধানী পক্ষ তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে বেপরোয়া গতিতে ছুটছে জাতীয় পর্যায়ের দিকে।
এখন-ই সময় লাগাম টেনে ধরার, নয়ত এই সমাজ, এই দেশ মূর্খতায় ভরে যাবে, ভরে যাবে বিচারহীনতায়, নষ্ট মানুষে।