চাচা খুব অসুস্থ, মেরুদন্ডে ব্যথা, দাঁড়াতে পারছেন না - তাঁর এই অবস্থায় আমাদের উৎকন্ঠার শেষ নেই। বৃষ্টির ভিতর খুলনায় রওনা হলাম ডাক্তার দেখানোর উদ্দেশ্যে।
চাচার একটু ঘাড় ত্যাড়া, ডাক্তার দেখাবে কিন্তু ভর্তি হয়ে কোন হাসপাতালে থাকবে না। ত্যাড়ামী তার ব্যক্তিগত সমস্যা না, জীনগত সমস্যা। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ব্যাপারে আমি হস্তক্ষেপ করার ধৃষ্টতা দেখালাম না, কেননা আমার ইচ্ছার বাইরেও কেউ কিছু করাতে চাইলে আমারও ত্যাড়ামী শুরু হয়।
তার ইচ্ছামত ডাক্তার দেখানোর জন্য ফোনে খোঁজ খবর নেওয়া শুরু করলাম। লোক মারফত জানতে পারলাম, শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের বর্হি: বিভাগে নাকি ভাল মানের ডাক্তার পরামর্শ পত্র দিয়ে থাকেন। শোনা মাত্র, আমার একমাত্র শ্যালকটাকে ফোন করলাম। শ্বশুর অসুস্থ থাকায়, তাঁর বেডের ব্যবস্থা করতে ও সিরিয়ালে কাগজপত্র জমা দিয়ে রেজাল্টের আশায় আছে। বিশেষায়িত এই হাসপাতালে বেড পেলে রোগীর কাগজপত্র জমা দিয়ে রেজাল্টের আশায় থাকতে হয়, পরীক্ষার ফলাফল দেওয়ার দিন হার্টবিট যতটা বাড়ে তারচেয়েও কয়েকগুণ বেশি শঙ্কা নিয়ে। ফোনে
- কোথায়?
- আবু নাসের...
- কি করো?
- অপেক্ষা
- কিসের?
- আব্বু সিট পাবে কি না তার রেজাল্ট দেড়টায়...
- খুলনায় আসতেছি...
- কখন?
- এখন?
- কেন?
- মেঝ কাকা অসুস্থ, আবু নাসেরে অর্থোপেডিক ডাক্তার আছে কি না দেখ, থাকলে টিকেট কাটো।
কিছুক্ষণ পর বিজয়ের ভঙ্গিতে ফোন,
- টিকেট কাটা শেষ, তাড়াতাড়ি আসেন।
যেতে যেতে আরো দু/ তিন বার কথা হলো। গিয়ে দেখি ডাক্তার এই দিন বসে না। নিশ্চয় ওকে কেউ মগজ ধোলাই দিয়ে বলেছে, ডাক্তার আছে। ও তো টিকেট কেটে বসে আছে। আমি অর্থোপেডিক্সের ডাক্তারের রুমের সামনে থেকে ফিরে আসছি এমন সময় একজন বলল, আপনার রোগীর কি সমস্যা? জানালাম মেরুদন্ডে ব্যথা, দাঁড়াতে পারছেন না। ঐলোক বলল, সামনে শেখ ডায়াগনস্টিক ঐখানে এই স্যারই আছে। বুঝলাম, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালাল।
ফিরছি এমন সময় আরেক জন জিজ্ঞাসা করলো কি সমস্যা, জানালাম। তিনি ডা: মো: ফয়সাল আলম নামে এক মেডিকেল অফিসারের কার্ড ধরিয়ে দিলেন। যিনি একই সঙ্গে মেডিসিন, হৃদরোগ, কিডনী, চর্ম-যৌন রোগে অভিজ্ঞ। যিনি কার্ড দিয়েছিলেন তার কথা, রোগীর অবস্থা খারাপ, স্যার আছে তাড়াতাড়ি নিয়ে যান। ঐ কার্ডের লেখা অনুযায়ী শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালেরই মেডিকেল অফিসার, বসেন শেখ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে।
আমার কথা হলো, তিনি একটি বিশেষায়িত হাসপাতালের ডাক্তার হয়ে এমন চৌকস দালাল রেখেছেন যে, সর্বরোগের ডাক্তার হিসাবে তাঁকে চিনিয়ে দিচ্ছে। কার্ডে গুরুত্ব দেয় না বা পড়তে পারে না বা অন্যের কথায় নির্ভরশীল তারা কি করতেন? নিশ্চিত ঐ মেডিকেল অফিসারকে দেখাতো আর আরো কিছুদিন রোগে ভুগে ডাক্তার পরিবর্তন করতো বা রোগকে জটিল করে তুলতো।
যেখানে ডাক্তারকে মানুষ দেবতার সঙ্গে তুলনা করে, সেখানে সেই দেবতা কেমন করে সম্পদ বৃদ্ধির জন্য দালাল লাগায়, হাসপাতালে কাঙ্খিত সেবা না দিয়ে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে, ক্লিনিকে সেবা দেয়। কমিশনের লোভে অপ্রয়োজনীয় টেষ্ট দিয়ে রোগীকে হয়রানী করে। আমার ছোট মস্তিষ্কে এতো বড় ব্যাপার আসে না।
ডাক্তারকে কেন নচিকেতার গানের কথা হতে হবে। কসাই ইচ্ছা করলে সবাই হতে পারে কিন্তু ডাক্তার বা দেবতা সবাই হতে পারে না। টাকা আয়ের মেশিন না হয়ে অতীত ইতিহাস ও ভবিষ্যতের কথা ভাবুন, উত্তর পেয়ে যাবেন - আপনি কে, আপনার কাজ ও দায়িত্ব কি, কি করা উচিৎ। সব উত্তর পাবেন, নিরিবিলি চোখ বন্ধ করে একটু ভেবে দেখবেন - এই ছোট্ট দেশটির কথা, সমাজের কথা।