বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস ২০২৫

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অর্জনে সাংবাদিকের আর্থিক নিশ্চয়তা ও সুরক্ষা নিশ্চিতের বিকল্প নেই

সংবাদ বিজ্ঞপ্তি

ঢাকা, ০৪ মে ২০২৫: গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অর্জনে সাংবাদিকের আর্থিক নিশ্চয়তা ও সুরক্ষা নিশ্চিতের বিকল্প নেই। বিশেষত, জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে সাংবাদিকের জীবনমানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বেতন-ভাতা, চাপমুক্ত ও ভয়ডরহীন সাংবাদিকতার পরিবেশ নিশ্চিত না করতে পারলে মুক্ত গণমাধ্যমের প্রত্যাশার বাস্তবায়ন অসম্ভব। বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস ২০২৫ উপলক্ষে ইউনেস্কো ঢাকা অফিস, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এবং সুইডেন দূতাবাসের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত প্যানেল আলোচনায় এ মন্তব্য করেন বক্তারা।

“Brave New Bangladesh: Reform Roadmap for Press Freedom” শীর্ষক এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো: মাহফুজ আলম এবং মুখ্য আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ। অনুষ্ঠানে আরও অংশগ্রহণ করেন ঢাকায় নিযুক্ত সুইডেনের রাষ্ট্রদূত হিজ এক্সেলেন্সি নিকোলাস উইকস, বাংলাদেশে ইউনেস্কোর প্রতিনিধি ও অফিস প্রধান সুজান ভাইজ। প্যানেল আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টারের চেয়ারম্যান রেজওয়ানুল হক রাজা, এএফপির ব্যুরো প্রধান শেখ সাবিহা আলম, টাইমস মিডিয়া লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ। প্যানেল আলোচনাটি সঞ্চালনা করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ।

ঢাকায় নিযুক্ত সুইডেনের রাষ্ট্রদূত নিকোলাস উইকস বলেন, ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতার মানে শুধু সংবাদ প্রকাশের স্বাধীনতা নয়, গণমাধ্যমের ভেতরেও সমতা থাকা জরুরি। বাংলাদেশে মাত্র ১০% সাংবাদিক নারী, এক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আবশ্যিক। নিউজরুমকে এমন জায়গা হিসেবে প্রস্তুত করতে হবে, যেখানে নারীরাও স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করতে পারেন। সাংবাদিকরা শুধু খবর দেন না, তারা সত্যের পক্ষে দাঁড়ান, জবাবদিহিতার পরিবেশ তৈরি করেন; যাদের কণ্ঠ মূলধারায় পৌঁছায় না, তাদের হয়ে কথা বলেন। একজন সাংবাদিককে চুপ করিয়ে দেওয়া মানে শুধু তার কণ্ঠরোধ করা নয়, সবার কণ্ঠ দমিয়ে দেওয়া।’

ইউনেস্কোর বাংলাদেশ প্রতিনিধি সুজান ভাইজ বলেন, ‘মুক্ত গণমাধ্যমের সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে, এই আয়োজন তা নিয়ে আলোচনার একটি সুযোগ সৃষ্টি করেছে। পাশাপাশি, এটি এমন একটি ভবিষ্যতের প্রস্তুতি নেওয়ার ক্ষেত্র, যেখানে একটি স্বাধীন ও বহুত্ববাদী গণমাধ্যম সাংবাদিকদের নির্ভয়ে তথ্য ও শিক্ষা প্রচারের এবং সমাজকে ক্ষমতায়নের পথ করে দেবে।’

অনুষ্ঠানে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ “সাহসী নতুন বাংলাদেশ: গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য সংস্কার রূপরেখা” শীর্ষক মূখ্য আলোচনা উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, ‘স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য ভয়, অর্থনৈতিক দুর্বলতা ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত পরিবেশ অপরিহার্য। এজন্য প্রয়োজন মৌলিক কাঠামোগত সংস্কার, মালিকানা স্বচ্ছতা, আর্থিক জবাবদিহি, সাংবাদিক সুরক্ষা ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা।’ তাঁর উপস্থাপনায় তিনি সাংবাদিক সুরক্ষা আইন অধ্যাদেশ আকারে পাশ করা, মিডিয়া কমিশন গঠন ও জাতীয় সম্প্রচার নীতি নির্ধারণে অধ্যাদেশ পাশ করা, বিটিভি, বেতার ও বাসস একত্র করে জাতীয় সম্প্রচার সংস্থা গঠন ও বোর্ড গঠন করা এবং নতুন নিয়োগ বিধিমালা ও আচরণবিধি দ্রুত প্রণয়নের ওপর জোর দেন।

প্যানেল আলোচনায় টাইমস মিডিয়া লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ বলেন, ‘সাংবাদিকদের স্বার্থরক্ষার দায় যাদের সেই প্রেস কাউন্সিল সরকারের আজ্ঞাবহ হয়েছে যার কারণে সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্বের জন্য জীবন ঝুঁকির মুখে পড়লেও দেখবার কেউ নেই। সামনে রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসবেন। গণমাধ্যমের বর্তমান করুণ চিত্র সংস্কারে কতটুকু আগ্রহী তারা হবেন তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। তাই এখনই গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত না হলে তা কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে।’

এএফপির ব্যুরো প্রধান শেখ সাবিহা আলম বলেন, ‘৫ আগস্টের পর গণমাধ্যমকে নিয়ে যে পরিমাণ নিন্দা কুৎসা রটেছে তা অন্য কাউকে নিয়ে হচ্ছে না। শুধুমাত্র গত ১৫ বছর নয়, এর আগেও সাংবাদিকতার পথটা কঠিনই ছিল। গণমাধ্যমের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে এই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটতে হবে। বিশেষত, নারীদের সাংবাদিকতায় আসার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তা, জীবনের নিরাপত্তা যে কোনো মূল্যে নিশ্চিত করতে হবে। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোতে মালিকপক্ষের লাঠিয়ালের কাজ করা সাংবাদিকদের দায়িত্ব নয়। যে গণমাধ্যমের মালিক মনে করেন তিনি গরীব, সাংবাদিকদের বেতন দিতে পারবেন না, তিনি তাহলে এ প্রতিষ্ঠান চালাবেন না। কারণ সাংবাদিকতা কোনো কুটির শিল্প নয়।’

ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টারের চেয়ারম্যান রেজওয়ানুল হক রাজা বলেন, ‘সম্প্রতি যে ৩ সাংবাদিক চাকরিচ্যুত হলেন তার মাধ্যমেই বাংলাদেশের সাংবাদিকদের সামনের চ্যালেঞ্জ দৃশ্যমান। মালিকপক্ষ নিজেদের প্রতিষ্ঠান বাঁচাতে এই পদক্ষেপ নিয়েছেন। এটা যদি চলমান থাকে, সাংবাদিকদের আর্থিক সামাজিক নিরাপত্তা যদি নিশ্চিত না করা যায় তাহলে স্বাধীন সাংবাদিকতার অস্তিত্ব থাকবে না। আড়াই শতাধিক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ঢালাও মামলা, অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল, যথেচ্ছ চাকরিচ্যুতি ইত্যাদি সংকট যদি নিরসন করা সম্ভব না হয়, তাহলে কিসের স্বাধীন গণমাধ্যম পেয়েছি আমরা? এ পরিস্থিতিতে মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে অগ্রগতি নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশের অবকাশ আসলে নেই।’

শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, সাংবাদিকতার শিক্ষক, ছাত্র, সাংবাদিকের অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিতের দাবিতে কাজ করা ব্যক্তিবর্গ মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। তারা বলেন, সাংবাদিকদের আর্থিক ও জীবনের নিরাপত্তা, হেনস্তা, চাপ ও ভয়হীনতার পরিবেশ সৃষ্টি না করতে পারলে মুক্ত গণমাধ্যমের অঙ্গীকার কাগজে কলমেই থেকে যাবে।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, ‘সকল প্রতিষ্ঠান যেমন গণমাধ্যমের জবাবদিহির আওতায় তেমনি গণমাধ্যমের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যারা আছেন তাদেরকেও প্রশ্ন করার সুযোগ দিতে হবে। আমরা কারও কণ্ঠরোধ করতে চাইনা। গণমাধ্যমকে প্রশ্ন তুলবার সুযোগ দিতেই হবে। তবে সেক্ষেত্রে প্রশ্নগুলো কতটুকু জবাবদিহিতার উদ্দেশ্যে আর কতটুকু ভিন্ন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তা খতিয়ে দেখবার প্রয়োজন রয়েছে।’ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়টি নিয়ে সরকার কাজ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ক্ষমতার অনেক ভরকেন্দ্র সৃষ্টি হয়েছে এবং মামলা বাণিজ্য এখনও চলমান। সংস্কার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তা চলতেই থাকবে। পরবর্তীতে যারা ক্ষমতায় আসবেন তাদের সদিচ্ছা না থাকলে এই সংস্কৃতি অব্যাহত থাকবে। তাই দ্রুতই সংস্কার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে সবাইকেই কাজ করতে হবে। আমি মনে করি কোনো স্বাধীনতাই নি:শর্ত নয়। সাংবাদিকদেরও জনগনের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে হবে।’

তথ্য উপদেষ্টার মন্তব্যের প্রেক্ষিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, জবাবদিহির কোন মানদণ্ড প্রয়োগ করতে হবে? যে কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহি করতে হয়। গণমাধ্যমের দায়িত্ব হচ্ছে জনস্বার্থে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা। এই নিরপেক্ষ ও স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্যই যেন সাংবাদিকদের বা গণমাধ্যমকে জবাবদিহির নামে হয়রানির শিকার হতে না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।’ সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী আইন প্রণয়নে উপদেষ্টার অঙ্গীকারকে সাধুবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কর্তৃত্ববাদের পতনের পরও আমরা দেখেছি বিভিন্ন আইনের খসড়া প্রস্তুতিতে রাখঢাক করা হচ্ছে, যা নতুন বাংলাদেশে অগ্রহণযোগ্য। সাংবাদিক সুরক্ষা আইনসহ বিভিন্ন আইনের খসড়া প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় অবশ্যই সকল অংশীজনকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।’

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরো বলেন, ‘কেউ “elephant in the room” সম্পর্কে কথা বলছি না। সেটি হলো রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সংবাদমাধ্যমের নজরদারির নামে স্বাধীনতা হরণের চর্চা, যা দীর্ঘদিন ধরে স্বাভাবিকতায় পরিণত করা হয়েছে। ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের পর এই সংস্থাগুলোতে ব্যক্তির পরিবর্তন হয়েছে, চর্চার পরিবর্তন কতটুকু হয়েছে, বা হবে তা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ক্ষমতাসীনদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে গণমাধ্যমের ওপর দীর্ঘকাল পুঞ্জীভূত নজরদারির যে চর্চা, হাতিয়ার ও কৌশল তারা অর্জন করেছেন, আবারও তার প্রয়োগ হবে না, এই নিশ্চয়তার জন্য কার্যকর সংস্কার করতে হবে। নিরাপত্তা বা গোয়েন্দা সংস্থার ওপর অর্পিত রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের উপযোগী সক্ষমতা ও এখতিয়ার নিশ্চিত করা অপরিহার্য। তবে এখতিয়ার বহির্ভূত কর্মকান্ডে জড়িয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে লিপ্ত হওয়া অগ্রহণযোগ্য। অন্যদিকে গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণে “গরু জবাই” এর মতো অরাষ্ট্রীয় হাতিয়ার যেনো নতুন স্বাভাবিকতায় রূপান্তরিত না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।’

গণমাধ্যম যোগাযোগ:

নুসরাত আমিন
হেড অব কমিউনিকেশনস অ্যান্ড পাবলিক এনগেজমেন্ট
ইউনেস্কো ঢাকা অফিস
মোবাইল: ০১৭৭৭৭৪১৪৬৯
ইমেইল: n.amin@unesco.org

 

মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম
পরিচালক, আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ
মোবাইল: ০১৭১৩-১০৭৮৬৮
ই-মেইল: tauhidul@ti-bangladesh.org

অনুষ্ঠানের ভিডিও লিংক

Read in English

World Press Freedom Day-2025: No Alternative to Ensuring Journalists’ Financial Security and Protection for Press Freedom


Press Release