ডেঙ্গু সংকট মোকাবিলায় যথাযোগ্য রাজনৈতিক ও সরকারি প্রাধান্য দেওয়া হয়নি: টিআইবি

সংবাদ বিজ্ঞপ্তি

ঢাকা, ৩০ অক্টোবর ২০২৩: সুনির্দিষ্ট পূর্বসতর্কতা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আন্তর্জাতিক মানের দিকনির্দেশনা এবং কর্মপরিকল্পনা থাকা সত্ত্বেও ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে পর্যাপ্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। পাশাপাশি, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব এড়ানোর অনৈতিক ও অমানবিক প্রবণতার কারণে সারাদেশে সর্বাধিক মৃত্যু ঘটেছে। একইসঙ্গে, ডেঙ্গু সংকট মোকাবিলায় ব্যর্থতার দায় অনৈতিকভাবে জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আজ সোমবার “ডেঙ্গু সংকট প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ” শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে নানা ঘাটতির পাশাপাশি ডেঙ্গু চিকিৎসায় নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে টিআইবির গবেষণায়। এডিস মশা ও ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে সুশাসন নিশ্চিতে ২১ দফা সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান। প্রতিবেদনটি উপস্থাপনা করেন টিআইবির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো মো. জুলকারনাইন এবং রিসার্চ ফেলো রাজিয়া সুলতানা।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ডেঙ্গুর প্রকোপ ধারাবাহিকভাবে সারা বছরব্যাপী বিদ্যমান থাকলেও এই রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক ও সরকারিভাবে পর্যাপ্ত গুরুত্ব প্রদান করা হয়নি। বাংলাদেশে ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কৌশলপত্র ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও বিদ্যমান আইন অনুসরণ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকর্তৃক সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ অনুসরণ, যথাযথ সাড়া প্রদান, ডেঙ্গু সংক্রমণ চিহ্নিকরণ ও সমন্বিত ডাটাবেজ প্রণয়ণ, মশা নিধন কার্যক্রমে সক্ষমতা, অংশীজনদের ভ‚মিকা ও সমন্বয়ে ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। একইসঙ্গে, ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নিজেদের মধ্যে সমন্বয় না করে যার যার মতো কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আবার, গবেষণার আওতাভুক্ত ১০ টি জেলার মাঠ-পর্যায় থেকে সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সকল সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম এখনও শুধুমাত্র রাসায়নিক পদ্ধতির (লার্ভিসাইড ও অ্যাডাল্টিসাইড) মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। কিছু কিছু এলাকায় পাবলিক প্লেসে মশার প্রজনন স্থল ধ্বংস করা হলেও এখনও ঘরে ঘরে মশার প্রজনন স্থল চিহ্নিতকরণ ও ধ্বংস করার কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। মাঠ পর্যায় থেকে সংগৃহীত তথ্যের বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, কোনো কোনো এলাকায় ৫ থেকে ২৭ বছর ধরে একই কীটনাশক ব্যবহৃত হচ্ছে। কীটতত্ত¡বিদ ও জনস্বাস্থ্য গবেষকদের মতে একই কীটনাশক বহু বছর ধরে ব্যবহারের ফলে মশা কীটনাশক সহনশীল হয়ে যায় এবং ঐ কীটনাশক প্রয়োগে মশা নিধন হয় না। কোনো কোনো এলাকায় কীটনাশকের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয় না। আবার অনেক এলাকায় কীটনাশকের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হলেও সেখানে কীটতত্ববিদ ও বিশেষজ্ঞদের কোনো সম্পৃক্ততা থাকে না। অন্যদিকে, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক স্বপ্রণোদিতভাবে তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।

গবেষণায় আরো দেখা যায়, ডেঙ্গু চিকিৎসা ব্যবস্থায় সক্ষমতার ঘাটতি ছিলো প্রকট। বাংলাদেশে মোট ডেঙ্গু মৃত্যুর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ষাটোর্ধ্ব বয়সী ব্যক্তিদের (১৯%)। এ ছাড়া আক্রান্তের সংখ্যা অনুপাতে ষাটোর্ধ্ব বয়সী ব্যক্তিদের মৃত্যু হার অনেক বেশি। ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তি তথা নারী ও বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি-বিষয়ক কার্যক্রম বা চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ গ্রহণে ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। অন্যদিকে, জনস্বাস্থ্য সংকটকে কাজে লাগিয়ে দুর্নীতি ও অনিয়মের ঘটনা উঠে এসেছে গবেষণায়। মশা নিধনে দায়িত্বরত মাঠ কর্মীদের ১০০-৫০০ টাকা দিলে বাড়িতে গিয়ে “অধিক কার্যকর” ওষুধ দিয়ে আসার অভিযোগ যেমন পাওয়া যায়, তেমনি ই-জিপির মাধ্যমে ওপেন টেন্ডারিং এর কিছু ক্ষেত্রে “সিঙ্গেল বিডিং” এর প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। একটি কীটনাশক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ওপেন টেন্ডারিং এর মাধ্যমে তিনটি সিটি কর্পোরেশনের ১৬টি ক্রয়াদেশ পায়, যার মধ্যে সাতটিতে একক বিডার হিসেবে টেন্ডারে অংশগ্রহণ করে প্রতিষ্ঠানটি। ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও অনিয়ম-দুর্নীতি পরিলক্ষিত হয়েছে। বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ১০০ টাকার শিরায় দেওয়া স্যালাইন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হয়েছে। আবার, ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু পরীক্ষার সুবিধা অপ্রতুল ছিল।

সুনির্দিষ্ট পূর্বসতর্কতা থাকা সত্ত্বেও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সুচিন্তিত কর্মকৌশল প্রণয়ন না করে, সমন্বয়হীন ও বিচ্ছিন্নভাবে এবং লোক দেখানো কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে প্রস্তাবিত কৌশল, দিকনির্দেশনা এবং কর্মপরিকল্পনা থাকলেও, বাংলাদেশে ডেঙ্গু মোকাবিলায় তার প্রতিফলনের কোনো দৃষ্টান্ত আমরা দেখিনি। অন্যদিকে, ডেঙ্গু মোকাবিলায় অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা, এমনকি কোভিড সংকটসহ জনস্বাস্থ্যবিষয়ক নিজস্ব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো হয়নি। সকল অংশীজনকে অন্তর্ভুক্ত করে কোভিড সংকট মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতার প্রতিফলনও আমরা ডেঙ্গু মোকাবিলায় দেখতে পারিনি। টিআইবি অনেক আগেই ডেঙ্গুকে জাতীয় জনস্বাস্থ্য সংকট ঘোষণার আহবান জানালেও তা আমলে নেওয়া হয়নি। উল্টো সংশ্লিষ্ট সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান দায়সারাভাবে ভূমিকা পালন করেছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে গ্রহণই করতে চায়নি। “অন্য দেশ থেকে আমরা ভালো করছি এবং আমাদের উদ্বেগের কারণ নেই”Ñ সংসদে এমন কথা বলে আত্মতুষ্টিমূলক প্রচারণাও চালানো হয়েছে। সর্বোপরি, ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি যথাযথ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রাধান্য পায়নি। একইসঙ্গে সমন্বয়হীনতার প্রকট উদাহরণও সৃষ্টি হয়েছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক ও উদ্বেগজনক।’

যে কোনো দুর্যোগের মতো ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে স্বার্থান্বেষী মহল দুর্নীতি ও অনিয়মের সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করেছে উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরো বলেন, ‘গবেষণায় আমরা দেখেছি, ক্রয়-প্রক্রিয়ায় উন্মুক্ত প্রক্রিয়ার নামে “সিংগেল বিডিং” বেশি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশের যোগসাজসে অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট প্রতারণামূলকভাবে লাভবান হয়েছে। আমরা দেখেছি, একদিকে যেমন ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকার ও সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে এবং সে দায় অনৈতিকভাবে জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে তেমন সেবাগ্রহণের ক্ষেত্রে সেবাগ্রহীতাদের অযাচিতভাবে অধিক মূল্য প্রদান করতে হয়েছে। ডেঙ্গু মোকাবিলায় সকল আক্রান্ত অঞ্চলে জনবল ও আর্থিক বরাদ্দের ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক অবস্থা পরিলক্ষিত হয়েছে। জবাবদিহিতার অভাবের কারণে অর্থের অপচয় হয়েছে এবং তা থেকে অসাধু মহল সুবিধা নিয়েছে।’

এডিস মশা ও ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধে ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে সুশাসন নিশ্চিতে গবেষণা ফলাফলের আলোকে ২১ দফা সুপারিশ করেছে টিআইবি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সুপারিশ হচ্ছে- ডেঙ্গুকে জাতীয় স্বাস্থ্য সংকট হিসেবে বিবেচনাসাপেক্ষে যথাযথ রাজনৈতিক ও সরকারিভাবে গুরুত্ব প্রদান করে বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সমন্বয়ে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা ও মানদÐ অনুসরণ করে এডিস মশাসহ অন্যান্য মশা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে “ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান” প্রণয়ন করা; পরিকল্পনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাত ও প্রতিষ্ঠান এবং অংশীজনদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সুনির্দিষ্ট করে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা; পরিকল্পনা অনুসারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয়/দপ্তরের কর্মকর্তা, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, কীটতত্ত¡বিদ, এনজিও প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে “ডেঙ্গু প্রতিরোধ-বিষয়ক জাতীয় কমিটি” করা ইত্যাদি।

গণমাধ্যম যোগাযোগ:
শেখ মনজুর-ই-আলম
পরিচালক
আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন
ফোন: +৮৮ ০২ ৪১০২১২৬৭-৭০
ই-মেইল: manjur@ti-bangladesh.org

Read in English

Inadequate Political and Administrative Priority to Dengue Crisis Management: TIB


Press Release