প্রকাশকাল: ২৫ জুন ২০২২
দুর্নীতি-ষড়যন্ত্রের অভিযোগ উত্থাপন করে তা প্রমাণ হওয়া তো দুরে থাকুক, কোনো প্রকার তদন্ত সম্পন্ন হওয়ার আগেই পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক তাদের প্রতিশ্রুত অর্থায়ন না করার ঘোষণা দেয়। অযৌক্তিক ও সম্পুর্ণ অপ্রত্যাশিত এই চ্যালেঞ্জকেই জাতির জন্য এক চিরস্মরণীয় অর্জনে রূপান্তর করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের জনগণের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি, যা আজ বাস্তবায়িত। এই গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনালগ্নে বিশ্বব্যাংক সম্পুর্ণ স্বেচ্ছাচারী ও অন্যায় সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বাংলাদেশকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিব্রত ও নাজেহাল করেছিল। সে জন্য বিশ্বব্যাংকের জবাবদিহি-সংশ্লিষ্ট কিছু প্রশ্ন আবারও উত্থাপন করা উচিত।
প্রথমত, বিশ্ব ব্যাংকের সিদ্ধান্ত ছিল স্বার্থের দ্বন্দ্বে দুষ্ট। পদ্মা সেতু প্রকল্পে কনসালট্যান্ট নিয়োগের জন্য তারা একটি প্রতিষ্ঠানকে প্রাধান্য দেওয়ার জন্য অনানুষ্ঠানিকভাবে সুপারিশ করেছিল বলে জানা যায়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে নির্ধারিত মাপের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা ছিল না। বরং তাদের জমা দেওয়া প্রস্তাবনায় জালিয়াতি প্রতীয়মান হওয়ায় উক্ত প্রতিষ্ঠান কারিগরি কমিটি দ্বারা বিবেচিত হয়নি। সঙ্গত কারণে এতে বিশ্বব্যাংকের নাখোশ হওয়ার কথা। এবং এই নাখোশ হওয়ার কারণেই কি তারা বাংলাদেশকে অর্থায়নের অঙ্গীকার থেকে সরে গিয়েছিল, এই প্রশ্নের কোনো ব্যাখ্যা এখনো পাওয়া যায়নি।
দ্বিতীয়ত, বিশ্বব্যাংকের জন্মলগ্ন থেকেই বিশ্বব্যাপী তাদের অর্থায়নে বিভিন্ন দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ সর্বজনবিদিত। এই দুর্নীতিতে বিশ্বব্যাংকের কর্মীদের একাংশের যোগসাজশ বা অংশগ্রহণ পর্যবেক্ষক মহলের কাছে কোনো নতুন সংবাদ নয়। বিষয়টি বিভিন্ন সময়ে বিশ্বব্যাংকের নিজস্ব উদ্যোগে প্রণীত নিরপেক্ষ তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। পাশাপাশি বিশ্বব্যাংকের শুদ্ধাচার ইউনিটও বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ উত্থাপন করেছে যে, তাদের অর্থায়নে বিশ্বব্যাপী বাস্তবায়িত বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতির প্রতিরোধে ব্যাংক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে তাদের স্বার্থের দ্বন্দ্বপুষ্ট পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিরুদ্ধে তথাকথিত দুর্নীতির অভিযোগটিকে নিজেদের দায় মোচনের লোক দেখানো পদক্ষেপ বলেই মনে হয়।
তিন, বিশ্বব্যাংকের কাছে প্রশ্ন ছিল, দুর্নীতির ষড়যন্ত্র বা এমন কি সরাসরি দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপনের পরও অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার আগেই প্রতিশ্রুত অর্থায়ন বাতিল করার অন্য কোনো উদাহরণ কি বিশ্বব্যাংক তাদের নিজের ইতিহাসে, বা অন্য কোনো প্রেক্ষিতে, বা কোনো গ্রহণযোগ্য বিচারিক প্রক্রিয়ায় দেখাতে পারবে? কোন যুক্তিতে বিশ্বব্যাংক তদন্ত শেষ হবার আগেই বা অভিযোগ প্রমাণের আগেই পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন থেকে সরে গিয়েছে, কেন অভিযুক্তকে অগ্রিম শাস্তি দেয়া হলো, কেন অভিযুক্তকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হলো না- এসব প্রশ্নেরও জবাব বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে পাওয়া যায়নি। যে কারণে প্রশ্ন উঠেছে, তথাকথিত দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগটি কি বাস্তবে অন্য কোনো অঘোষিত এজেন্ডা বা ষড়যন্ত্রের মুখোশ ছিল কি না?
একই সঙ্গে বলতে হয়, স্বার্থের দ্বন্দ্বে দুষ্ট তথাকথিত দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের যে অভিযোগ প্রমাণিত হলো না, তা যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল না, এবং এটি যে বাংলাদেশকে সে সময় বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করার জন্য বিশ্বব্যাংকের অপপ্রয়াস ছিল না, তার প্রমাণ কি বিশ্বব্যাংক দিতে পারবে? বিশ্বব্যাংকের সদস্য দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কি এসব প্রশ্নের জবাব চাইতে পারে না? বিশ্বব্যাংক কি জবাবদিহির উর্ধ্বে?
ইফতেখারুজ্জামান: নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি
দৈনিক বাংলা
২৫ জুন, ২০২২